সোমবার ● ১৫ জুলাই ২০১৯
প্রথম পাতা » ডিজিটাল বাংলা » জরুরী নিরাপত্তায় প্রযুক্তি
জরুরী নিরাপত্তায় প্রযুক্তি
দুটি ঘটনা দিয়ে লেখা শুরু করা যাক। প্রথমটি রাহেলার। বাড়ির চারতলা থেকে তিনি প্রায়ই চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেতেন। তরুণ দম্পতি, অথচ ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে ওদের। মাঝেমধ্যে ভারী জিনিস ছোড়াছুড়ির আওয়াজও পান। মানসিকভাবে তীব্র চাপ অনুভব করলেও অন্যের বিষয়ে নাক গলাবেন না, এমনটা ভেবেই চুপ করে থাকেন রাহেলা। একদিন চারতলা থেকে নেমে রাহেলার দরজায় নক করে মেয়েটি। তাঁর ঠোঁট কাটা, রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে চোখের চারপাশে। জানালেন, স্বামী মেরে এই অবস্থা করেছে। গলা টিপেও ধরেছিলেন। কোনোরকমে হাত ছাড়িয়ে নিচে নেমে এসেছেন তিনি। আর একটুও দেরি করেন না রাহেলা। ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে দ্রুত হেল্প ডেস্ক প্রতিনিধির কাছে সাহায্য চাইলেন। প্রতিনিধি কাছাকাছি থানার সঙ্গে তাঁর সংযোগ করিয়ে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই থানা থেকে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সায়মাকে সব সময়ই বনানী থেকে খিলগাঁও যাতায়াত করতে হয়। মাঝেমধ্যেই রাত হয়। একদিন বেশ বিপদে পড়েন তিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, কোনো যানবাহন পাচ্ছেন না। আশপাশে বেশ কয়েকটি ছেলে ঘুরঘুর করছে। একজন আবার এগিয়ে আসে কথা বলতে। খুব ভয় পেয়ে যান সায়মা। দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন। ছেলেগুলোও এগোতে থাকে তাঁর পেছন পেছন। উপায় না দেখে ফোনের ইমারজেন্সি লোকেশন ব্যবহার করে নিজের অবস্থান জানান এক বন্ধুকে। ভাগ্য ভালো, কাছেই থাকেন ওই বন্ধু। অল্প সময়ের মধ্যেই চলে আসেন।
যুগ পাল্টাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের তাগিদেই আধুনিকতা ও প্রযুক্তিকে বেছে নিচ্ছে মানুষ। এখন বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য সব সময়ই ছুটতে হয় না মানুষকে। হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রটার সঠিক ব্যবহার অনেক সময় তাঁকে বাঁচিয়ে দিতে পারে মহাবিপদ থেকে। ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক, বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের নিরাপত্তা সেবা বা অ্যাপের মাধ্যমে অবস্থান জানানো যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রিয়জনকে, যিনি কিনা তাৎক্ষণিকভাবে রক্ষা করতে পারবেন বিপদ থেকে।
২৪ ঘন্টা চালু থাকে ৯৯৯
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত ন্যাশনাল হেল্প ডেস্কের ৯৯৯ এখন বেশ জনপ্রিয়। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশের নাগরিকদের জরুরি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে এই সেবা চালু হয়।
৯৯৯ নম্বরের কল সেন্টারটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। যেকোনো মোবাইল নম্বর থেকে সম্পূর্ণ টোল ফ্রি কল করে সেবা পাওয়া যায়। সাড়ে চার শ প্রশিক্ষিত এজেন্ট জরুরি মুহূর্তে প্রয়োজন অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এ রকম এক কর্মীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কতগুলো কল রিসিভ করেছেন তিনি? জবাবে জানান ১৪০টির মতো। বেশির ভাগই ফাঁকা কল। তবে এর মধ্যে বিপদে পড়া মানুষেরও কল আছে। আলি আকবর নামের ওই কর্মী জানান, যেসব কল আসে, সেগুলো প্রধানত দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, ছিনতাইয়ের ঘটনার। তবে মাঝেমধ্যে ইভ টিজিংয়ের কিছু ঘটনাও তাঁরা পান। কোনো নারী বিপদে পড়েছেন, এমন ফোন এলে সরাসরি থানার সঙ্গে দ্রুত সংযোগ করিয়ে দেওয়া হয়।
রবির ইচ্ছেডানা
মূলত নারীদের প্রয়োজনের দিকটি মাথায় রেখে কিছুদিন আগে ‘ইচ্ছেডানা’ নামের ডিজিটাল জীবনধারাভিত্তিক একটি বিশেষ সেবা এনেছে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি। সেবাটিতে ইমারজেন্সি অ্যালার্টের মতো সুরক্ষা ফিচার রয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক তাঁদের পূর্বনিবন্ধিত তিনটি নম্বরে জরুরি প্রয়োজনে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বর্তমান অবস্থান জানাতে পারবেন।
জানিয়ে দিন নিজের অবস্থান
বিভিন্ন রাইড ভাগাভাগির অ্যাপ ব্যবহার করে যাতায়াত করলেও নিজের লোকেশন সহজে প্রয়োজনীয় মানুষকে জানানো যায়। যেমন যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে পাঠাওয়ে আছে লাইভ লোকেশন ভাগাভাগি, র্যাপিড রেসপন্স টিম ও কল সেন্টার সাপোর্ট। আরেক রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবারেও নিরাপত্তাবিষয়ক এসব ব্যবস্থা আছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, চালক ট্রিপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর উবার অ্যাপের হোম স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সেফটি টুলকিট অপশন, ট্রিপ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই অপশন ব্যবহারের সুযোগ থাকে। এ ছাড়া ট্রাস্টেড কন্টাক্টসের মাধ্যমে যাত্রীরা তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে নিয়মিতভাবে ট্রিপ ভাগাভাগির সুযোগ পান। প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রিপ শেয়ার সেটিংস ঠিক করে রাখা যায়। সুবিধাটির সাহায্যে যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত সব খবরাখবর জানতে পারেন তাঁর কাছের লোকজন। এগুলো বাদেও ইমারজেন্সি বোতামে সরাসরি ৯৯৯-এ কল করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া উবার অ্যাপে আগে থেকেই চালকের নাম, ছবি, গাড়ির ধরন এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখার সুযোগ আছে। রেটিং দেখে অনুমান করা যাবে চালক ভালো না মন্দ। উবারে ‘শেয়ার মাই স্ট্যাটাস’ অপশন ব্যবহারের মাধ্যমে যাত্রার যাবতীয় তথ্য ইচ্ছানুযায়ী ফোনবুকে থাকা আপনজনের নম্বরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারেন গ্রাহক। ফলে যেকোনো সময়ে গাড়ি কোন রাস্তা বা স্থানে আছে, তা নির্ণয় করতে পারবেন তাঁরা।
জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের পুলিশ সুপার (এসপি) তবারক উল্লাহ বলেন, ‘নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। সব পুলিশ বিভাগকেই এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সেনসিটিভ থাকার নির্দেশনা দেওয়া আছে। এই সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে সর্বনিম্ন চার মিনিটের মধ্যে আমরা সাহায্য পাঠিয়েছি-এমন ঘটনা আছে।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে একবার এক মেয়ের ওপর কয়েকজন হামলা চালায়। মেয়েটি বিপদে পড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ৯৯৯-এ ফোন করে। সে নিজের ঠিকানাও বলতে পারেনি। কেবল একটা ভবনের কথা জানায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তিনটি থানার সঙ্গে যোগাযোগ করি। বর্ণনা অনুযায়ী ওই ভবন খুঁজে মেয়েটিকে উদ্ধার করি। ওই ব্যক্তিদেরও আটক করা হয়।
জিপিএসের সাহায্য নিন
মোবাইলে জিপিএস থাকলে কাউকে বর্তমান অবস্থান চেনাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। ইন্টারনেটে সংযোগ থাকলে কেবল লোকেশন শেয়ার করে দিলেই বন্ধুদের জানা থাকবে কোথায় আছেন। প্রায়ই দেখা যায়, আমরা আমাদের প্রিয়জনদের ফোনে পাচ্ছি না। ওপাশে ফোন বাজতেই থাকে, কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। খুব টেনশন হয়। এমন অবস্থায় মোবাইলে ট্র্যাকিংও করা যায়। যেমন গ্রামীণফোনের “জিপি বাডি ট্র্যাকার”-এর মাধ্যমে আমরা যেকোনো সময় সহজেই জেনে যেতে পারি যে আমাদের পরিবার-পরিজনেরা কে কোথায় আছেন।’