বুধবার ● ২২ মে ২০১৯
প্রথম পাতা » আইসিটি শিল্প ও বানিজ্য » টেলিনর-আজিয়াটার একীভূতকরণ, টেলিযোগাযোগে নতুন চ্যালেঞ্জ
টেলিনর-আজিয়াটার একীভূতকরণ, টেলিযোগাযোগে নতুন চ্যালেঞ্জ
এশিয়ায় টেলিনর-আজিয়াটার একীভূতকরণের ঘোষণা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই একীভূতকরণের আওতায় বাংলাদেশে টেলিনরের মালিকানাধীন গ্রামীণফোন এবং আজিয়াটার রবি না থাকলেও দুটি কোম্পানি কৌশলগত ব্যবসায়িক সুবিধা নেবে। এটা সরকারের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং এ খাতের অন্যান্য কোম্পানির ব্যবসাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। কারও কারও মতে, বাংলাদেশের বাজারকে প্রাধান্য দিয়েই এশিয়ায় টেলিনর-আজিয়াটা একীভূত হওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
বিশেষজ্ঞদের আরও মত, বাংলাদেশের বাজারে বাংলালিংকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভারতের রিলায়েন্স জিও এলে টেলিযোগাযোগ খাতে প্রতিযোগিতার নতুন অধ্যায় রচিত হবে। তবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক এ ইস্যুতে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চান না।
বাংলাদেশের বাজারই মুখ্য :টেলিনরের ২০১৮ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী নরওয়েসহ আটটি দেশে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই টেলিযোগাযোগ কোম্পানির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এই আটটির মধ্যে বাংলাদেশে গ্রাহক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ৭ কোটি ২৭ লাখ। গ্রাহক সংখ্যায় টেলিনরের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান টেলিনর পাকিস্তান, তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লাখ।
গ্রামীণফোনের ২০১৮ সালের শেষ প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাদের বার্ষিক আয় ছিল ১৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, নিট মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। আর টেলিনর পাকিস্তানের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে রাজস্ব আয় ছিল ২ হাজার ৮২২ কোটি পাকিস্তানি রুপি বা ১ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, টেলিনরের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের মোট রাজস্ব আয়ের চেয়ে বাংলাদেশের বাজারে গ্রামীণফোনের নিট মুনাফা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি। এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের গ্রামীণফোনের অবস্থান টেলিনরের টেলিকম ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুদিন আগে গ্রামীণফোনকে বাংলাদেশের বাজারে এসএমপি (সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার বা তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতার অধিকারী) ঘোষণার মাধ্যমে কিছু বিধিনিষেধ আরোপের কারণেই টেলিনর নতুন করে ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণে মনোযোগী হয়। এরই ফল হচ্ছে আজিয়াটা-টেলিনরের একীভূতকরণ।
টেলিযোগাযোগ খাতের একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসএমপি ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বাজারে নিশ্চিতভাবেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গ্রামীণফোন। এটা টেলিনরের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, টেলিনর গ্রুপের আয়ের অন্যতম উৎস বাংলাদেশ। বিধিনিষেধের কারণে আগামীতে রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তাদের আশঙ্কা প্রবল হয়। এ কারণে টেলিনর দিনশেষে সবচেয়ে দক্ষ বাজার-কৌশল বেছে নিয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাজারে গ্রামীণফোনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছিল রবি ও এয়ারটেলের একীভূতকরণ। এর নামও হয় রবি। গত দুই বছরে রবির ব্যবসায়িক কৌশলের কাছে দৃশ্যত মার খেয়েছে গ্রামীণফোন। এ অবস্থা বিবেচনা রেখেই আজিয়াটার সঙ্গে একীভূত হতে উৎসাহী হয়েছে টেলিনর গ্রুপ। এর মধ্য দিয়ে বাজারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন গ্রামীণফোনের বাজার অংশীদার হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে কৌশলগত কারণে রবি ও গ্রামীণফোন এক হচ্ছে না, তবে গ্রামীণফোনের মালিকানা পাচ্ছে একীভূত টেলিনর-আজিয়াটা। আর রবি আজিয়াটার মালিকানাধীন হিসেবেই থাকছে। অর্থাৎ গ্রামীণফোনের শেয়ারের মালিকানা পাচ্ছে আজিয়াটা। আর আজিয়াটার মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে পরোক্ষভাবে রবির সম্পদের অংশীদার হবে টেলিনর। শেষ বিচারে ‘নন-ক্যাশ’ একীভূতকরণ বলা হলেও গ্রামীণফোন ও রবির সম্পদের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আয়ের অংশীদারও হবে আজিয়াটা ও টেলিনর। একীভূত কোম্পানিতে টেলিনরের শেয়ার বেশি বলে শেষ বিচারে টেলিনরই বেশি লাভবান হবে।
তাহলে আজিয়াটা একীভূত হতে আগ্রহী হলো কেন? এই কর্মকর্তা বলেন, আজিয়াটার বিবৃতিতেই এ বিষয়টি পরিস্কার করা হয়েছে। এশিয়ায় আজিয়াটার বড় বাজার থাকলেও তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রযুক্তিগত রূপান্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা। এক্ষেত্রে আজিয়াটা নিজের সক্ষমতায় এগিয়ে গেলেও এখন পাশে পাচ্ছে টেলিযোগাযোগ খাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও দক্ষ রূপান্তরে এগিয়ে থাকা টেলিনরকে। ফলে আজিয়াটার সামনে এশিয়ার বাজারে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ও শক্তিশালী টেলিযোগাযোগ কোম্পানি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। একইসঙ্গে টেলিনরের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের শেয়ারের অংশীদারও হচ্ছে আজিয়াটা। এটাও তাদের বড় অর্জন। ফলে বাংলাদেশের বাজারে আজিয়াটা এবং টেলিনরের ‘উইন উইন’ বা উভয়পক্ষের লাভবান হওয়ার মতো অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিবেচনায় বাংলাদেশের বাজারকেই প্রাধান্য দিয়ে আজিয়াটা-টেলিনর একীভূত হয়েছে, এটা বললে ভুল হবে না।
যেখানে চ্যালেঞ্জ :প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে বলেন, টেলিনর-আজিয়াটার একীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাজারে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও একে অপরের সহযোগী হয়ে যাবে। এর ফলে গ্রামীণফোন ও রবি সরাসরি একীভূত না হলেও বাজারে তাদের যৌথ অবস্থানে ‘একক আধিপত্যে’র সৃষ্টি হবে। এই আধিপত্য সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ যৌথভাবে ৭৬ শতাংশ গ্রাহকের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এ ছাড়া দুটি অপারেটরের হাতে দেশের সিংহভাগ টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো, ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক, বেতার তরঙ্গ সবকিছুই থাকছে।
এই অবস্থানও এ খাতের অন্যান্য কোম্পানি বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, ট্রান্সমিশন সেবা দেওয়ার জন্য পৃথক লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু গ্রামীণফোন ও রবির কাছে যে পরিমাণ নিজস্ব ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক আছে এবং তারা যেভাবে কৌশলে বিটিসিএল কিংবা রেলওয়ের মাধ্যমে নিজেদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করছে সেটা অবশ্যই এ খাতের অন্যান্য কোম্পানিকে অসম প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়েছে। এখন এই চ্যালেঞ্জটাই আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেল। যেমন টাওয়ার কোম্পানির লাইসেন্স পাওয়া ইডটকো আজিয়াটার অবকাঠামো ইউনিট। এখন আজিয়াটা-টেলিনর একীভূত হওয়ার কারণে ইডটকো বাংলাদেশে একচেটিয়াভাবেই রবি এবং গ্রামীণফোনকে সেবা দেওয়ার সুযোগ পাবে। এর ফলে অন্য যারা টাওয়ার কোম্পানির লাইসেন্স নিয়েছিল, ব্যবসা শুরুর আগেই তাদের ব্যবসার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে গেল।
তিনি আরও বলেন, বাংলালিংক অধিগ্রহণের মাধ্যমে ভারতের রিলায়েন্স জিও’র বাংলাদেশের বাজারে আসার কথা শোনা যাচ্ছে। সত্যিই রিলায়েন্স এলে দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় প্রতিযোগিতার নতুন অধ্যায় রচিত হবে।
অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের সবকিছুই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মোবাইল অপারেটররা যে কোনো ধরনের সেবা দিতে চাইলে আইন অনুযায়ী বিটিআরসির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। মূল্যও নির্ধারিত হয় বিটিআরসির নির্দেশনা অনুসারে। ফলে এই উচ্চ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় দুটি প্রতিষ্ঠান একীভূত হলেই একচেটিয়া কিছু করে ফেলার সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, এসএমপি নীতিমালার কারণেই বাংলাদেশে রবি-গ্রামীণফোনের একীভূত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ একীভূত হলে বাজারের দখল ৮০-৮৫ শতাংশ হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমতি দেবে না। এ কারণেই বাংলাদেশে রবি ও গ্রামীণফোনের কার্যকম কৌশলগতভাবে পৃথক থাকছে। তবে গ্রামীণফোন ও রবি বাংলাদেশে একীভূত না হলেও ব্যবসায়িক কৌশলে তারা সুবিধা নেবে।
তিনি আরও বলেন, এখনকার পরিস্থিতিতে সরকারের টেলিটক নিয়ে সক্রিয়ভাবে ভাবা উচিত। বড় বিদেশি বিনিয়োগ কিংবা বড় কোম্পানির সঙ্গে টেলিটকের একীভূত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। টেলিটকের ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আনার বিষয়টি জোরালোভাবে ভাবতে হবে যেন টেলিটক আরও ভালো বিনিয়োগ পায় এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়। টেলিটক শক্তিশালী হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে।