রবিবার ● ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১২
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহ কি স্বাধীন?
ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহ কি স্বাধীন?
আজকাল মানুষের জ্ঞান এমন সব তথ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ ছাড়া যেগুলো অর্জন করা বেশ কঠিন। উন্নয়ন এখন তার প্রাচীন অর্থ হারিয়েছে। এখন উন্নয়ন তথ্য এবং যোগাযোগের ওপর বেশি বেশি সম্পৃক্ত। বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে শক্তি এবং ক্ষমতা সেখানেই পুঞ্জীভূত যেখানে বেশি বেশি তথ্য রয়েছে।তথ্যের ভূমিকা এবং গুরুত্বের কারণে আজকাল এক্ষেত্রে বেশ প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে বিশেষ করে তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে। বর্তমান বিশ্বে “অবাধ তথ্য প্রবাহ” এবং “তথ্য পাবার সমান অধিকার” একটি সমাজের স্বাধীনতার পরিচায়ক। কিন্তু অবাধ তথ্য প্রবাহ পদ্ধতি কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? সবাই যাতে সমানভাবে তথ্য পেতে পারে সেই পরিস্থিতি কী করে নিশ্চিত করা যাবে? তথ্যের স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় এবং এর কী মূলনীতি রয়েছে? তথ্য বা ইনফরমেশন বলতে সবধরনের দলিলপত্র, ফাইল ইত্যাদিকে বুঝায় যা দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং স্থানান্তরযোগ্য। তথ্য প্রযুক্তি হলো সমাজে তথ্যের প্রচার এবং প্রসারের সিস্টেমগুলো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কম্পিউটার এই তথ্য প্রযুক্তিগুলোর একটি। ইন্টারনেট সিস্টেম চালু করার মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। কেননা, এরফলে সর্বস্তরের জনসাধারণের তথ্য অর্জনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিছুদিন আগে থেকে মার্কিন সিনেটে ইন্টারনেট তথ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ সংক্রান্ত একটি বিলের ওপর পর্যালোচনা চলছে। এই বিলটির নাম হচ্ছে Stop Online Piracy Act’ সংক্ষেপে সোপা’ বা “ইন্টারনেট চৌর্যবৃত্তি বন্ধ সংক্রান্ত আইন।” যুক্তরাষ্ট্রের আইনী সীমার বাইরে যেসব ওয়েবসাইট তাদের তৎপরতা চালিয়ে মার্কিন লেখক ও প্রকাশকের অধিকার লঙ্ঘন করছে কিংবা অন্যদেরকে অধিকার লঙ্ঘনে সহযোগিতা করছে এই বিলে মার্কিন আইন মন্ত্রণালয়কে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেসে যদি এই বিলটি পাস হয় তাহলে মার্কিন সরকারী কৌঁসুলি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ইন্টারনেট বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং ইন্টারনেট কার্যক্রমে হিসাব নিষ্পত্তিকারী সংস্থাগুলোকে আদেশ দিতে পারবে, যেসব বিদেশি সাইট মার্কিন লেখক ও প্রকাশকদের অধিকার লঙ্ঘন করছে তাদের সাথে যেন সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়।
মিউজিক বা চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িতগণ এই বিলটিকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। পক্ষান্তরে বাকস্বাধীনতার ওপর সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতা আরোপের কথা ভেবে বহু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব এই বিলের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যারা এই বিলের বিরেোধী তারা মনে করেন এই আইন পাস হলে সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোসহ ইন্টারনেট নেটওয়ার্কগুলোতে তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হতে পারে এমনকি বন্ধও করে দেওয়া হতে পারে। ইন্টারনেটে তথ্য প্রাপ্তির ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপকারী বিলটির বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে বিভিন্ন ভাষায় ইন্টারনেট বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া’। উইকিপিডিয়া এর প্রতিবাদস্বরূপ গত ১৮ জানুয়ারি ২৪ ঘণ্টার জন্যে তাদের ইংরেজি সাইটটি বন্ধ রেখেছে। উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ‘জিমি ওয়েলস’ তাদের ঐ সিদ্ধান্তকে সমগ্র উইকিপিডিয়ার সিদ্ধান্ত বলে ঘোষণা করেছেন। সোপা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে পেরে এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে গর্বিত বলেও মনে করছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জিমি ওয়েলস একা ছিলেন না, আরো কয়েকটি সাইটও কালো পোশাক পরে একদিন তাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
সোপা’র বিরুদ্ধে এই সাইটগুলোর প্রতিবাদ একেবারে বিফলে যায়নি, তাদের প্রতিবাদের ফলে মার্কিন কংগ্রেসে এই বিলটির সমর্থন কমেছে, বিলে যারা সই করেছেন তাদের অনেকেই তাদের স্বাক্ষর প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ইন্টারনেট নিউজ মিডিয়াগুলোসহ এই বিলের বিরোধীদের অব্যাহত প্রতিবাদ থেকে মনে হচ্ছে মার্কিন কংগ্রেসে বিলটি পাশ করার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ বাধার সৃষ্টি করতে না পারলেও অন্তত ঐ বিলে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা অবশ্যই হবে। তবে অনেকেই ভাবছেন ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ কি সত্যিই এবং সবর্ব্যাপী নাকি এতে রাজনৈতিক পক্ষ বিপক্ষভেদে তারতম্য রয়েছে?
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইন্টারনেট সেন্সর প্রক্রিয়া ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। গেল বছর বাহরাইনসহ কোনো কোনো দেশে ওয়েব ব্লগ লেখক এবং মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। তারা ইন্টারনেটে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে লেখালেখি করতেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর বিশ্বব্যাপী ১২১ জনকে তাদের স্পর্শকাতর লেখার জন্যে কারাগারে যেতে হয়েছে। যেসব দেশে ইন্টারনেটের ওপর ব্যাপক কড়াকড়ি করা হয়েছে সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভিয়েতনামসহ সৌদিআরবের মতো কোনো কোনো আরব দেশ।
কিছুদিন আগে গুগলের নির্বাহী পরিচালক এরিখ স্মিথ বলেছেনঃ “গুগল যদিও চায় না কোনো কোনো দেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা হোক, তবু এটা তো স্পষ্ট যে আরব দেশগুলোতে গণ বিক্ষোভের কারণেই ইন্টারনেটে সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, এমন অনেক দেশ আছে গুগল তাদের ইউজারদেরকে উৎসাহিত করাটা খুবই স্পর্শকাতর কেননা তাকে অবৈধ বলে মনে করা হয়। এ কারণে কোনো অন্যায় না করার পরও ইউজারদেরকে আটক করার আশঙ্কা থেকে যায়।”
অবশ্য গুগলের নির্বাহি পরিচালক যা-ই বলুন না কেন গুগল কিন্তু একেবারে নিষ্পাপ নয়। অনেক সময় বিভিন্ন দেশ ও সরকা গুগলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানায় সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কার্যক্রমের তথ্য যেন তাদেরকে গোপনে সরবরাহ করা হয়। বৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন এই গুগলও সেইসব সরকারের আবেদনে প্রায়ই সাড়া দেয়। “ইন্টারনেট” নামে বিশেষ যে গ্রুপটি রয়েছে তাদের প্রকাশিত সর্বপ্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে গুগল মাত্র ছয় মাসে বিশ্বের উন্নত ২৬টি দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ইউজারদের কার্যক্রমের গোপন তথ্য সরবরাহের আবেদন সম্বলিত চৌদ্দ হাজার চিঠি পেয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ আবেদনই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এই দেশটি গুগলের বরাবরে চার হাজার ছয়শ’ একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, গুগলের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কোম্পানী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শতকরা চুরানব্বুই ভাগ আবেদনে সাড়া দিয়েছে। ঐ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ব্রিটেন ব্রাউজারদের ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহের আবেদন জানিয়ে গুগলকে এক হাজার একশ’ বাষট্টিটি চিঠি লিখেছে। আবেদনের সংখ্যার দিক থেকে বৃটেনের অবস্থান কিন্তু চার নম্বরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর ব্রাজিল এবং ভারতের অবস্থান। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্রিটেন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ব্রাজিল হুমকিধর্মী কিংবা রাজনৈতিক তথ্যগুলোকে সেন্সর করার জন্যে সবচেয়ে বেশি বেশি আবেদন জানিয়েছে গুগলের কাছে। এক্ষেত্রে ব্রিটেন সর্বোচ্চ রেকর্ডধারী দেশ। দেশটির পক্ষ থেকে যে পরিমাণ বিষয়বস্তু বাদ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে, তার সংখ্যা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের আবেদনের তিন গুণ। ৯৩ হাজারেরও বেশি লেখা বাদ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে বৃটেনের পক্ষ থেকে। তারমধ্যে গুগল দেশটির ৮৯ ভাগ আবেদনে সাড়া দিয়েছে। প্রতিবেদনটির পরিসমাপ্তিতে জানানো হয়েছে, ইন্টারনেট থেকে এ ধরনের বিষয়বস্তু বাদ দেওয়ার আবেদনের পরিমাণ আগের বছরগুলোর তুলনায় ব্যাপক বেড়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে শতকরা ১২৩ ভাগ, জাপানের পক্ষ থেকে ২৭১ এবং পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে বেড়েছে ২১৬ ভাগ।
তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতার নীতিমালা অনুযায়ী সর্বপ্রকার তথ্য পাবার অধিকার কিংবা সেসব সম্পর্কে মত দেওয়া, সমালোচনা করা, এদিক সেদিক পাঠানো ইত্যাদির অধিকার জনগণের রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃতও বটে। কিন্তু মানবাধিকারের তথাকথিত ধ্বজাধারীদের এইসব কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায় “অধিকারের” শ্লোগানটি একেবারেই গণপ্রতারণামূলক। পশ্চিমা এই দেশগুলোই আবার তাদের বিরোধী দেশগুলোতে ইন্টারনেটের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপের সমালোচনা করে। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা বলতে কেবল পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থানুকূল তথ্যকেই বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, অন্যদের ব্যাপারে নয়।