বৃহস্পতিবার ● ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৫
প্রথম পাতা » আইসিটি শিল্প ও বানিজ্য » অবৈধ ভিওআইপির ভয়াবহ নেটওয়ার্ক থামানো যাচ্ছে না
অবৈধ ভিওআইপির ভয়াবহ নেটওয়ার্ক থামানো যাচ্ছে না
বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) বন্ধের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নিলেও কোনো সুফল মিলছে না। বরং রাজধানী ঢাকা ছাড়াও অবৈধ কল টার্মিনেশন ব্যবসা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভাগীয় শহরসহ দেশের বড় বড় শহরেও। গত কয়েক মাসে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের অভিযোগে ৭১ লাখ মোবাইল সিম ও এক লাখ আইটি অ্যাড্রেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি মোবাইল অপারেটরকে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। তবুও থামানো যাচ্ছে না টেলিফোন খাতের সর্বগ্রাসী বাণিজ্যটি। খবর বাংলাদেশ প্রতিদিনের।পত্রিকাটি বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই ভিওআইপি বাণিজ্য কেবলমাত্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। অন্যান্য বিভাগীয় শহর ছাড়িয়ে ভিওআইপির অবৈধ বাণিজ্য এখন জেলাপর্যায়েও বিস্তৃতি পেতে চলেছে। সম্প্রতি গাজীপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সরঞ্জাম আটক করা হয়েছে। এই ব্যবসা এখন চলছে অত্যাধুনিক ‘রেডিওলিংক’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। এদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভিওআইপি বিরোধী অভিযানে তেমন সক্রিয় নেই র্যাব। মাঠে নেই বিটিআরসি কর্মকর্তারাও। ফলে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য এখন রমরমা ভাবেই চলছে। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী ব্যবসায়িরা জানান, রেডিওলিংকের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বেশি হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়। তবে রাজধানীতেও হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিওলিংক ব্যবহার করে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা করছেন অনেকে।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারজনিত কারণে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের সামনে বিটিআরসি রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন শনাক্ত করতেও ব্যর্থ হচ্ছে বিটিআরসি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কিছু লোককে ম্যানেজ করে থাকে। ফলে কল লিস্ট মুছে ফেলাসহ আধুনিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারকে ফাঁকি দিতে উন্নতমানের সফটওয়্যার ব্যবহার করে এই প্রযুক্তিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছেন কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। তারা ভারত থেকে স্বল্পমূল্যে ব্যান্ডউইডথ কিনে ১/২ বা আরও বেশি ই-ওয়ান ভয়েস কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে অবৈধ পথে বৈদেশিক কল আদান-প্রদান করছেন।
নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে কোনো কল বৈধ পথে এলে টেলিফোন নম্বরটির আগে অবশ্যই যোগ চিহ্ন থাকবে। কিন্তু রেডিওলিংকের মাধ্যমে অবৈধ পথে আসা কলগুলোতে যোগ চিহ্ন পাওয়া যাবে না। ‘কল রেস্ট্রিকটেড’, ‘আননোন কল’, ‘ফরেন কল’, ‘নাম্বার রেস্ট্রিকটেড’ বা ৯৯৯০০০৯৯৯০৯৯৯, ০০৯৯০১৫৫৯৯৬৫১, ৯৯৮৭৮৯৬৭০৯৭৬৫ বা ভুয়া বিদেশি নম্বর বা বিভিন্ন দেশের কোড নম্বরের সঙ্গে ইচ্ছামতো নম্বর বসিয়ে এসব অবৈধ বৈদেশিক কল সংযোগ দেওয়া হয়। খুবই উন্নতমানের সফটওয়্যার দিয়ে এসব বৈদেশিক কলে প্রেরকের ফোন নম্বর প্রদর্শনে বাধা দেওয়া হয়। ফলে বিদেশি কল এলেও প্রেরক নম্বরটির স্থলে বাংলাদেশি যে কোনো মোবাইল নম্বর প্রদর্শন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া হয়। এক চিঠিতে যত শিগগির সম্ভব ভিওআইপি মনিটরিংয়ের জন্য সিএমএস স্থাপন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন বন্ধের জন্য মহাখালী ও মগবাজার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে বিটিআরসি ও র্যাব যৌথ অভিযান চালিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিওআইপি সরঞ্জাম ও ব্যবসায়ীকে আটক করে। অতিসম্প্রতি রাজধানীর পুরানা পল্টন ও চট্টগ্রামেও র্যাব অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ছিটেফোঁটা এসব উদ্ধার অভিযানে ভিওআইপি বাণিজ্য বিন্দুমাত্র থামাতে পারছে না। বরং যতই দিন গড়াচ্ছে ততই ভিওআইপি বাণিজ্যের বিস্তার বেড়ে চলছে।
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৭১ লাখ সিম এবং লক্ষাধিক আইটি অ্যাড্রেস। বিটিআরসির নিয়ম অনুসারে দেশের কোনো মুঠোফোন নম্বরে ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিনিটের বেশি মিনিট কল হলে তা অবৈধ ভিওআইপির ব্যবহার সন্দেহে বন্ধ করা হয়। এ ছাড়াও কয়েকটি মোবাইল অপারেটরকে জরিমানাসহ ৫টি পিএসটিএন অপারেটর ও ৩২টি আইএসপি অপারেটরের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ভিওআইপি বন্ধে শুরু থেকেই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগগুলো বরাবরই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। র্যাবের সহায়তায় বিটিআরসি ছোটখাটো কিছু অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন ব্যবসায়ীর কর্মচারী ও সরঞ্জাম আটক করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে রাঘববোয়ালরা।
দুই বছর আগে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে ‘অবৈধ ভিওআইপি অনুসন্ধান’ শীর্ষক তদন্ত কমিটি গঠন করে বিটিআরসি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিটিআরসির কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি টেলিটকের মাধ্যমেই অবৈধ ভিওআইপির পরিমাণ অস্বাভাবিক আকারে বেড়েই চলেছে। জনবল সংকটের কারণে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির তথ্যাদি যাচাই করতেই পারেনি তদন্ত কমিটি। বিটিআরসি অতি সম্প্রতি ভিওআইপি বন্ধের নামে আরেকটি কল রেট কমানোর অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ৩১৬ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি পরীক্ষামূলক আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট ৩ সেন্ট থেকে কমিয়ে ১ দশমিক ৫ সেন্ট করে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল কলরেট কম হলে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের কাছে ধরনা দেবেন না কেউ। কিন্তু ফল হয় উল্টো। অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের তৎপরতাও কমেনি, সরকারের বৈধ ব্যবস্থার কল সংখ্যাও বাড়েনি। মাত্র তিন মাসেই ৪১ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব হারাতে হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৩১৬ কোটি। বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুন থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট রাজস্বের পরিমাণ ছিল ২০ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার ১০২ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে কল টার্মিনেশন রেট ৩ সেন্ট থেকে ১ দশমিক ৫ সেন্টে নামিয়ে আনার পর ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ ১৬ হাজার ৫৮৭ মার্কিন ডলার।