বৃহস্পতিবার ● ৫ জানুয়ারী ২০১২
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ৩ বছর
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ৩ বছর
০ ২৯৬ উপজেলায় ফাইবার অপটিক কেবল সংযোগ
০ ৪৫০১ ইউপিতে তথ্যসেবা কেন্দ্র
ফিরোজ মান্না ॥ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে এখনও অনেক সময় বাকি। এরপরেও গত তিন বছরে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দেশ বহুদূর এগিয়ে গেছে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচী, আর জীবনের প্রয়োজনেই মানুষ নিজ উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ মাধ্যমে জীবন-জীবিকার অনেক কিছুই জড়িয়ে আছে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। গ্রামের মানুষের কাছেও দিনরাতের পার্থক্যের দেশ আমেরিকার দূরত্ব নেই। দেশের মানুষ এখন নিজেদের বিশ্ব নাগরিক ভাবতে শুরু করেছে। সীমান্তের কাঁটাতার তাদের আটকে রাখতে পারছে না। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ অধিকার আদায় করছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন করে তাদের পতন ঘটিয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু বলেন, ৫৬টি জেলার ২৯৬টি উপজেলায় ফাইবার অপটিক কেবল সংযোগ হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি সেবা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের নেয়া পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি আউটলেট, কাগজবিহীন ভর্তি পরীৰা, পিডিবি ও তিতাস গ্যাসের বিল পেমেন্ট, ডেমরায় কম্পিউটারাইজড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কলসেন্টার, শিক্ষা পদ্ধতিতে আইসিটি, এসএমএস-ভিত্তিক ভোটকেন্দ্র সংক্রান্ত তথ্য, হজ ব্যবস্থাপনা, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফল প্রকাশ, ট্রেনের টিকেট কেনা, অনলাইন সার্ভিস ট্র্যাকিং সিস্টেম, অনলাইনে ডেইলি মার্কেট প্রাইজ জানা, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস অটোমেশন, রাজউকের কম্পিউটারাইজেশন এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, জাতীয় ওয়েব পোর্টাল, আইনবিষয়ক ওয়েব পোর্টাল, দুর্যোগ পূর্বাভাস, ভোটার ডাটাবেজ, পানি ও সামুদ্রিক সম্পদ পরিকল্পনা, কৃষিসম্পদ পরিকল্পনা, এডুকেশন পস্ন্যানিং, বাংলাদেশ ব্যাংক অটোমেশন, সড়ক ও জনপদ পরিকল্পনা অটোমেশন উলেস্নখযোগ্য। দেশের ৫টি উপজেলায় কমিউনিটি ই-সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে এবং অন্য উপজেলাগুলোতেও ই-সেন্টার স্থাপন করা হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ইন্টারনেটের কল্যাণে নতুন প্রজন্ম এখন এক দেশের নাগরিক নয়। তারা এখন বিশ্ব নাগরিক। বাংলাদেশের ৬ হাজার তরুন-তরুনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সেক্টরে কাজ করছে। দেশেও বহু তরুন-তরুনী বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানির কাজ করে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারছে সাধারণ মানুষ। এটা অত্যন্ত শুভ দিক। মধ্যপ্রাচ্যে মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশ হয়েছে ইন্টারনেটের কল্যাণে। গত তিন বছরে দেশ তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) জিয়া আহমেদ বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে দেশকে শতভাগ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। এখন দেশের সব প্রান্ত থেকেই মানুষ সহজে যোগাযোগ করতে পারে। গত তিন বছরে টেলিকম সেক্টরে ২৬ ধরনের লাইসেন্স থেকে ৫১৫টি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিছু লাইসেন্স বাতিলও করা হয়েছে। ২০০২ সালে ব্রডব্যান্ড ওয়ারলেস একচেঞ্জ (বিডব্লিউএ) দু’টি লাইসেন্স দেয়া হয়। গত তিন বছরে ছয়টি আইএসপিকে ১৬টি ই-ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে ফিঙ্ড ওয়াইম্যাঙ্ সার্ভিসের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) দু’টি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। দু’টি কোম্পানি সারাদেশে ১৬ হাজার কিলোমিটার ফাইবার অপটিক কেবলের আওতায় এনেছে। এ সেক্টরে আরও লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে, যাতে গোটা দেশ ফাইবার কেবলের মধ্যে চলে আসে। আইপি ফোন সার্ভিসের ৩৯ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এ সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে দেশের ভেতর ইন্টারনেট গ্রাহকরা স্বল্পমূল্যে ভয়েস কল করতে পারছে। ২৭টি আনত্মর্জাতিক এবং ১৭টি নতুন ডমেস্টিক কলসেন্টারের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর আগে আরও ২০ কল সেন্টারের লাইসেন্স দেয়া হয়। ইন্টারন্যাশনাল লং ডিস্ট্যান্স (আইএলডিটিএস) পলিসি অনুযায়ী রেগুলেটরি এ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে।
আইজিডব্লিউ (ইন্টারনেট গেটওয়ে), আইসিএক্স (ইন্টার কানেকশন একচেঞ্জ), আইআইজি ( ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে), ব্রডব্যান্ড ওয়ারলেস একসেস (বিডব্লিউএ), কল সেন্টার, মোবাইল অপারেটর, ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রেরিয়াল কেবলসহ বিভিন্ন ধরনের গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালা, টেলিফোন নম্বর ও শর্ট কোড নীতিমালা, লাইসেন্সিং রেগুলেশন, ইউনিব্যান্ড নীতিমালা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেন জানান, সিমিউই-৫ কেবল কনসোর্টিয়ামের যুক্ত হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন কাজ হচ্ছে অর্থ সংগ্রহ করা। দ্বিতীয় কেবলটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে দেশে নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ থাকবে। কোন কারণে একটা কেবল কাটা বা বন্ধ থাকলে অন্য কেবলের মাধ্যমে ব্যাকআপ রাখা যাবে। সব দিক চিন্তা করে মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। এতে বাড়তি আরও ১৬০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ যোগ হবে। বর্তমানে দেশে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ৪৪ দশমিক ৬ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ (ব্যান্ডউইথ হচ্ছে ইন্টারনেটের একক) দেশে আসছে। বাড়তি ১৬০ গিগাবাইট যোগ হলে দেশে মোট ব্যান্ডউইথ হবে ২০৪ দশমিক ৬ গিগাবাইট।
সরকারের সংশিস্নষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়েই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আলোচিত তিনটি বছর কেটেছে। এ বছরগুলোতে ফ্রিল্যান্সাররা বাংলাদেশকে বিশ্বসেরা তৃতীয় আউটসোর্সিং দেশ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ও থ্রিজি (তৃতীয় প্রজন্ম) মোবাইল চালু হলে তথ্যপ্রযুক্তির আরও বহুগুণ উন্নয়ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাসত্মবায়নের জন্য দেশে অনেক তথ্যপ্রযুক্তির মেলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় সম্মেলন হয়েছে-ই-এশিয়া সম্মেলন। এই সম্মেলনে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং কাজ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওডেস্কের চেয়ারম্যান ম্যাট কুপার এবং কম্পিউটার যন্ত্রাংশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের প্রেসিডেন্ট জন ডেভিস অংশ নিয়েছিলেন। বেসরকারী পর্যায়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ব্যক্তি পর্যায়ে ফ্রিল্যান্সারদের। তাদের কারণেই ওডেস্কর রেটিং শীর্ষ তিনে উঠে এসেছে ঢাকা শহর। আউটসোর্সিং দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম স্থানে। ২০১০ সালে পার্টনারের রের্টিং ও আউটসোর্সিং ডেস্টিনেশন হিসাবে ৩০ দেশের তালিকায় ছিল। ২০১১ সালজুড়েই দেশে তথ্যপ্রযুক্তির মেলা হয়েছে। এ বছরের ৬ জুলাই সরকারী উদ্যোগে আয়োজিত হয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা। এর মাধ্যমে ৩১ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়। গত বছরের ১৪ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতি সংঘের মহাসচিব বান কি মুন দেশের ৬৪ জেলায় ই-সেবাকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এ সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে ৬৪ জেলার ডিসি অফিসে রেকর্ডরম্নমের নকল তোলাসহ নানা সেবা পাচ্ছে দেশের মানুষ। সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে স্বল্পমূল্যে দোয়েল নামের ল্যাপটপ সংযোজন। টেলিফোন শিল্প সংস্থার টেসিসের মাধ্যমে এ ল্যাপটপ বাজারে ছেড়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তবে ইন্টারনেট সেবার মান নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেছে গোটা তিন বছর। বেশি দামে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ এবং কম গতি থাকায় সেবার মান ছিল কিছুটা নিম্নমানের।
সূত্র জানিয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার বাসত্মবায়ন করার ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষ থেকে দেশের ৪ হাজার ৫০১ টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) তথ্য সেবাকেন্দ্রের (ইউআইএসসি) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে।
২০১১ সালে চালু করা হয়েছে জেলা পর্যায়ে ই-গভর্নেন্স। এতে প্রশাসনে কাজের গতি বেড়েছে। এ সেবার কারণে অনেকাংশে দুর্নীতি কমে গেছে। বিভিন্ন দফতরের টেন্ডার জমা দিতে হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ই-টেন্ডারিংয়ে টেন্ডারবাজির সুযোগ নেই। জনগণও তাদের ন্যায্য সেবা পাবে। সরকারী পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, ধীরে ধীরে মানুষ ই-গবর্নেন্সের বিষয়টি বুঝে উঠবে। সাধারণ মানুষের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। মানুষ এখন প্রযুক্তিসচেতন হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষ এখন অনেকটাই তাল মিলিয়ে চলছে। ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।