শুক্রবার ● ১১ জুলাই ২০১৪
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » যৌনকর্মীর জালে সিলিকন ভ্যালি
যৌনকর্মীর জালে সিলিকন ভ্যালি
নিজের ইয়টে (প্রমোদতরি) মরে পড়ে আছেন এক নির্বাহী কর্মকর্তা। যেন কোনো কিছুই ঘটেনি, এমন ভঙ্গিতে তাঁকে মাড়িয়ে যাচ্ছেন এক ‘উঁচু দরের’ যৌনকর্মী। নিজের পোশাক, হেরোইন তুলে নিয়ে গ্লাসের শেষ মদটুকু পান করতে দেখা যাচ্ছে ওই যৌনকর্মীকে। এটি চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য নয়, গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে গেছে এ ঘটনা।
নিহত ওই ব্যক্তি হলেন গুগলের নির্বাহী ফরেস্ট হায়েস। ৫১ বছর বয়সী হায়েস পাঁচ সন্তানের জনক। গুগল গ্লাস প্রকল্পে কাজ করতেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের শান্তা ক্রুজের পুলিশের পক্ষ থেকে ২৬ বছর বয়সী অ্যালিক্স টিকেলম্যান নামের ওই যৌনকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ইয়ট থেকে উদ্ধার করা সর্ভিলেন্স ভিডিও বিশ্লেষণ করে টিকেলম্যানের ইয়টে ওঠা থেকে শুরু করে তাঁর চলে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু খতিয়ে দেখেছে তারা।
সান্তা ক্রুজের ডেপুটি পুলিশপ্রধান স্টিভ ক্লার্ক বলেছেন, হায়েসের সঙ্গে টিকেলম্যানের আগেও সাক্ষাৎ ঘটেছে। ২৩ নভেম্বর তাঁরা দুজন স্বেচ্ছায় ওই ইয়টে আসেন। ইয়টে হেরোইন নেওয়া পর্যন্ত সবকিছু দুজনের সম্মতিতে হয়েছিল। ইনজেকশনের মাধ্যমে হায়েসকে বিষাক্ত হোরেইন দিয়েছিলেন টিচেলম্যান।
ক্লার্ক দাবি করেছেন, কাউকে বিপদে ফেলে সটকে পড়ার ঘটনা টিচেলম্যানের ক্ষেত্রে এবারই প্রথম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অঙ্গরাজ্যেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এখানে এক ধরনের আচরণগত মিল দেখা গেছে, যাতে কেউ বিপদে পড়লে টিকেলম্যান কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন না।
ক্লার্ক জানিয়েছেন, হায়েস নিয়মিত মাদকসেবী ছিলেন কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। তবে মনে হচ্ছে, মাদক নেওয়ার জন্য টিকেলম্যানকে ডেকেছিলেন তিনি। ৪ জুলাই গ্রেপ্তার হন টিকেলম্যান।
এক গোয়েন্দা সান্তা ক্রুজ এলাকায় দামি একটি রিসোর্টে কোটিপতির ছদ্মবেশে টিকেলম্যানকে ফাঁদে ফেলে গ্রেপ্তার করেন। এর আগে তাঁর অবস্থান শনাক্ত করতে পারেননি বলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে স্বীকার করেছেন ক্লার্ক।
সিলিকন ভ্যালির কোটিপতিরা যৌনকর্মীর জালে
সান্তা ক্রুজের ডেপুটি পুলিশপ্রধান স্টিভ ক্লার্ক দাবি করেছেন, সিলিকন ভ্যালিতে টিকেলম্যানের আরও অনেক ক্লায়েন্ট রয়েছে। উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত সিলিকন ভ্যালি ৩০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত একটি এলাকা। ১৯৯৫ সালের পর সিলিকন ভ্যালি হয়ে ওঠে ইন্টারনেট অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ২০০০ সালের পর থেকে এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় চার হাজার তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান। এটিই এখন অর্ধশত বিলিয়নিয়ার ও হাজার হাজার মিলিয়নিয়ারের আবাসস্থল।
স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনমান-বিষয়ক সংস্থা জয়েন্ট ভেঞ্চার সিলিকন ভ্যালির প্রেসিডেন্ট রাসেল হ্যানকক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২৮ বছর আগের সিলিকন ভ্যালি এখন আর আগের মতো নেই। নিঃসন্দেহে সিলিকন ভ্যালির আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিছু একটা ঘটেছে। আমরা আগে এখানে প্রযুক্তিপ্রেমীরা মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করতাম কিন্তু এখন আমরা এমন একটি ভ্যালিতে বাস করছি যেখানে ধনী ব্যক্তিরা সঙ্গে করে টয় পুডল (একজাতীয় হাইব্রিড কুকুর) নিয়ে ঘোরেন।’
অ্যালিক্স টিকেলম্যানপুলিশের দাবি, সিকিং অ্যারেঞ্জমেন্ট নামের একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন টিকেলম্যান। এই ওয়েবসাইটে মেইল ও বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে ২০০ জনের বেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। সুন্দর সঙ্গী জুটিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ধনী ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছতেন টিকেলম্যান। সিলিকন ভ্যালির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তারা তাঁর ক্লায়েন্ট তালিকায় রয়েছেন।
সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট হেন্ডারশট বলেন, হঠাৎ করে সম্পদশালী হওয়া ব্যক্তিরা যেমন তাঁদের সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন, তেমনটি সিলিকন ভ্যালির অঢেল অর্থের মালিকদেরও সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। তবে সিলিকনভ্যালিতে নির্দিষ্ট কোনো ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতি নেই বলে জানান তিনি।
গুগলের আড়ালের কথা
বাইরে থেকে গুগলকে যতটা রঙিন আর আকর্ষণীয় বলে মনে হয়, আসলে এর আড়ালের গল্পটা আরও বেশি বর্ণিল। বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় গুগলের মাউনটেন ভিউ ক্যাম্পাসের চার দেয়ালের আড়ালে গুগল এক রাজনীতি আর যৌনতার আখড়া।
গুগলে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন এবং গুগলের মূল ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন এমন একজন কর্মীর বক্তব্য হচ্ছে, গুগলের আড়ালের গল্প যেন মার্কিন টিভি শো ‘গেম অব থর্নস’-এর মতো। যেখানে রয়েছে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কর্তৃত্বের যুদ্ধ, উত্তরাধিকার নিয়ে সুচতুর পরিকল্পনা, যৌনতা আর রাজনীতি।
গুগলের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রকাশ্য কোনো সংঘাত নেই সত্যি, তবে যৌনতা আর রাজনীতি? গুগল সূত্র জানায়, অবশ্যই রাজনীতির কূটচাল আর যৌনতার মতো বিষয়গুলো গুগলের সঙ্গে রয়েছে।
গুগলের আড়ালের গল্প যাঁরা বলেছেন এবং লিখেছেন, তাঁরা সবাই বিষয়টিকে তুলে এনেছেন। গুগল যখন যাত্রা শুরু করেছিল সে সময়কার ঘটনা নিয়ে লেখক ডগলাস অ্যাডওয়ার্ডস তাঁর লেখা ‘আই অ্যাম ফিলিং লাকি: দ্য কনফেশন অব গুগল এমপ্লয়ি নাম্বার ৫৯’ নামের বইয়ে তুলে ধরেছেন গুগলের আড়ালের বেশ কয়েকটি ঘটনা। এ বইতে গুগলের সাবেক মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিদার করিনসের ভাষ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, গুগলের চারপাশের বাতাসে হরমোন উড়ছে এবং অনেকেই তাঁর ঘরের দরজা পর্যন্ত বন্ধ করতে ভুলে গেছেন।
গুগলের প্রকৌশলীদের অনেককেই এমন অনাকাক্সিক্ষত অবস্থায় ধরা হয়েছে, যাতে তাঁদের চাকরি থাকার কথা নয়। কিন্তু গুগল কর্তৃপক্ষ কাউকে চাকরিচ্যুত করেনি। এর পর থেকে ধীর ধীরে গুগলের কর্মীদের মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ সম্পর্কগুলোকে আবার ঠিক অস্বাভাবিক সম্পর্কের পর্যায়ে ফেলা যাবে না। স্বাভাবিক ও গতানুগতিক এ সম্পর্কের কারণে এর আগে কখনো কোনো কেলেঙ্কারি ছড়ায়নি। গুগলের কর্মীদের মধ্যে যদি সম্পর্ক গড়ে ওঠে তবে তাঁরা ডেটিংয়ে যান, পরে বিয়ে করে নেন বা সম্পর্ক ভেঙে ফেলেন। এ ধরনের সম্পর্কের বিষয়গুলো কবে ঘটল, কারও তেমন চোখে পড়ে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নয়।
প্রযুক্তি ওয়েবসাইট ‘অল থিংস ডিজিটাল’ গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনের ব্যক্তিগত জীবনের একটি স্ক্যান্ডালের তথ্য জানায়। গুগলের এক জুনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় সের্গেই ব্রিনের সংসার ভেঙে যায়। অথচ সের্গেই ব্রিনের ওই প্রেমিকার সম্পর্ক ছিল হুগো বাররা নামের গুগলের আরেক কর্মীর সঙ্গে। এ ঘটনার পর হুগো বাররা গুগল ছেড়ে চীনের শাওমি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। ব্রিনের এ ঘটনার মতো গুগলে আরও ঘটনা রয়েছে।
গুগলের কর্মকর্তাদের মধ্যে পরকীয়ার ঘটনাও অনেক রয়েছে। সহকর্মী ও অধস্তনদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর বিষয়টি নতুন ঘটনা নয়। গুগলের এক যুগলের কথা শোনা যায় যাঁরা স্বামী-স্ত্রী হলেও গোপনে দুজনই আরও দুজনকে বিয়ে করেছেন এবং তাঁদের সন্তানও রয়েছে। এ ছাড়াও গুগলের চেয়ারম্যান এরিক স্মিডের স্ত্রীকে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ একবার তাঁর স্বামীর পরকীয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি স্বতন্ত্র জীবনযাপন করি।’
গুগল এমন একটি কর্মস্থল যেখানে সবকিছুর ক্ষেত্রেই প্রচ্ছন্ন অনুমতি পান এখানকার কর্মকর্তারা। গুগলে কাজের সময় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া এক কর্মী বলেন, গুগল থেকে অনেক বিষয়ে ছাড় পাওয়া যায়। প্রযুক্তি ও ব্যবসায় দক্ষ কর্মীদের নিয়ে গড়া গুগলের মতো একটি কর্মপরিবেশে মানুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। যাঁরা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বেন, তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আটকে রাখা যাবে না। ওই কর্মী দাবি করেন, শুধু গুগলে নয়, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানের পেছনের গল্পও একই।