শনিবার ● ২২ জুন ২০১৩
প্রথম পাতা » ডিজিটাল বাংলা » ধানকাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দী একই যন্ত্রে !!!
ধানকাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দী একই যন্ত্রে !!!
প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমাদের কৃষিখাত ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে । বিশেষ করে ধান গবেষণায় বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে। এইতো কিছু দিন আগে আমাদের ডঃ আবেদ স্যার আবিস্কার করলেন একবার ধান লাগিয়ে দুইবার ফসল তোলার পদ্ধতি। এবার একসঙ্গে ধানকাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দী করার যন্ত্র তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কৃষক আনোয়ার হোসেন (৫০)। যন্ত্রটি দিয়ে এ বছর দিনাজপুরের কয়েকটি এলাকায় বোরো ধান কেটে ঘরেও তুলেছেন কৃষকেরা।
যন্ত্রটি ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ নামে পরিচিত। এতে ধান কাটায় প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় সময় ও খরচ অনেক কম লাগে। আর মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে অনেক ধানের অপচয়ও হয় না।
নতুন-পুরোনো যন্ত্রপাতি ও লোহালক্কড় দিয়ে আনোয়ার হোসেনের এই যন্ত্র তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের পরিকল্পনা কমিশন, কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং ঢাকার ডেনিশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। সর্বশেষ ১৩ জুন যন্ত্রটি দিয়ে ধান কাটা দেখতে গিয়েছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা।
ফুলবাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের জমির মালিক জাকির হায়দার বলেন, যন্ত্রটি দিয়ে দেড় ঘণ্টারও কম সময়ে এক একর জমির ধান কাটা-মাড়াই-ঝাড়া ও বস্তায় ভরা যাচ্ছে। টাকা দিতে হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার। যন্ত্রটি ভাড়ায় নেওয়ার জন্য অনেক কৃষকই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তিনি ১৫ দিন আগে যোগাযোগ করে যন্ত্রটি ভাড়া পেয়েছেন।
একই এলাকার কৃষক মনছের আলী, শওকত ও শমসের হোসেনের সঙ্গেও কথা হয়। তাঁরা বলেন, বর্তমানে একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি সর্বনিম্ন ৪০০ টাকা। কমপক্ষে ১৫ জন শ্রমিক সারা দিন কাজ করলে এক একর জমির ধান কাটা-মাড়াই করতে পারেন। ব্যয় হয় কমপক্ষে ছয় হাজার টাকা। তা ছাড়া শ্রমিক দিয়ে কাজ করালে অনেক ধানের অপচয়ও হয়। কিন্তু এ যন্ত্রে অপচয়ের বালাই নেই।
আনোয়ারের তৈরি কম্বাইন্ড হারভেস্টারের প্রথম ব্যবহারকারী কৃষক মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ওই যন্ত্র দিয়ে তিনি দুই দিনে ১০ একর জমির ধান কেটেছেন। এতে তাঁর খরচ পড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এক ছটাক ধানও তাঁর নষ্ট হয়নি। ওই ধান শ্রমিকদের দিয়ে কাটালে কমপক্ষে ৬৫ হাজার টাকা খরচ হতো।
যন্ত্র তৈরি কারক আনোয়ার হোসেন বলেন, এই প্রথম দেশীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে কম্বাইন্ড হারভেস্টার তৈরি করা হলো। কোরিয়ার তৈরি হারভেস্টারের চেয়ে তাঁর তৈরি যন্ত্রে কৃষকের অর্ধেকেরও বেশি টাকা সাশ্রয় হবে। কোরিয়ার যন্ত্রটির দাম প্রায় ২৯ লাখ টাকা হলেও তাঁর খরচ হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। তবে যন্ত্রটি আরও দক্ষ, টেকসই করতে হলে খরচ হবে মোট প্রায় নয় লাখ টাকা।
কোরিয়ার কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে এক একর জমির ধান কাটা-মাড়াই-ভাড়া ও বস্তায় ভরতে সময় লাগে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। ডিজেল লাগে ১৫-১৬ লিটার। যন্ত্রটির গতি কম হওয়ায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে আলাদা গাড়ি লাগে। খুচরা যন্ত্রাংশ সহজে পাওয়া যায় না। বড় শহরে পাওয়া গেলেও দাম বেশি। কিন্তু আনোয়ারের তৈরি কম্বাইন্ড হারভেস্টারে একই পরিমাণ জমির কাজে সমান সময় লাগলেও ডিজেল খরচ পাঁচ-ছয় লিটার। গতি বেশি হওয়ায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজেই নেওয়া যায়। ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশও সহজলভ্য। তিন দিন প্রশিক্ষণ দিলে যে কেউ এই যন্ত্র চালাতে পারেন।
যেভাবে হারভেস্টার তৈরি: কৃষক পরিবারের সন্তান হলেও আনোয়ার পেশায় ছিলেন পল্লি চিকিৎসক। সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামের মানুষের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন ফুলবাড়ীর আলাদীপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের এই বাসিন্দা। কিন্তু চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই দরিদ্র এবং তাঁর পরিচিত আশপাশের গ্রামবাসী হওয়ায় তিনি তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিতেন না। ফলে কৃষি থেকে কিছু আয় থাকলেও সংসারে বেশ টানাটানি পড়ে যায়।
এই অবস্থায় আনোয়ার চিকিৎসা পেশা বাদ দিয়ে কৃষিতে মনোযোগী হন। ২০০৬ সালে কৃষিযন্ত্র কেনায় সরকারি সহায়তার সুযোগ নিয়ে কোরিয়ার তৈরি একটি রিকন্ডিশন্ড কম্বাইন্ড হারভেস্টার কেনেন। ধান কাটার মৌসুমে কৃষকদের মধ্যে ওই যন্ত্রের ব্যাপক চাহিদা হয়। তাঁরও ব্যবসা জমে ওঠে।
এরপর আনোয়ার পর্যায়ক্রমে আরও পাঁচটি যন্ত্র কেনেন। কিন্তু এক বছর পর দেখা দেয় বিপত্তি। শুরু হয় যন্ত্রের ছোটখাটো সমস্যা। বাজারে যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। কিছু যন্ত্রাংশ সরাসরি কোরিয়া থেকে আনতে হয়। দামও বেশি। দুই বছর পরই তাঁর সব কটি যন্ত্র ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
আবার আনোয়ার ধারদেনায় জড়িয়ে পড়েন। এই অবস্থায় পুরোনো যন্ত্রগুলোর কিছু কিছু অংশ ব্যবহার করে নিজেই কম্বাইন্ড হারভেস্টার তৈরির কাজে হাত দেন। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করে ফুলবাড়ী-মাদিলাহাট সড়কে সুজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ‘ফুলবাড়ী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’। ২০১০ সালেই প্রথম যন্ত্রটি তৈরি করেন তিনি। কিন্তু সেটিতে সামান্য ত্রুটি থাকায় ব্যবহারযোগ্য হয়নি।
এই সময় সরকার শুরু করে খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার উৎসাহিত করতে কৃষকদের ঋণ সহায়তা এবং ভর্তুকি দামে যন্ত্রপাতি কেনার সুযোগ দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণবিষয়ক মেলা, সভা-সেমিনারেও যোগ দিতে থাকেন আনোয়ার হোসেন। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি দেখে দেখে চলতে থাকে নিজের তৈরি যন্ত্রটির ত্রুটি সংশোধন। অবশেষে ২০১২ সালের শেষের দিকে তিনি সফল হন। এখন যন্ত্রটি আরও আধুনিক করতে কাজ করছেন। তিনি দুটি যন্ত্র তৈরি করেছেন। সহায়তা পেলে আরও আধুনিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার তিনি কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারবেন।
আনোয়ার হোসেন বলেন, কম্বাইন্ড হারভেস্টার তৈরিতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক শেখ মো. নাজিম উদ্দীন।
নাজিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, এই যন্ত্র বর্তমানে কৃষিকাজে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ভরা মৌসুমে ধান কাটার জন্য প্রয়োজনীয় মজুর পাওয়া যায় না। মজুরিও অনেক বেশি। কাজেই আনোয়ারের তৈরি যন্ত্রটি উন্নয়নে সরকার তাঁকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।