শুক্রবার ● ২২ মার্চ ২০১৩
প্রথম পাতা » নিউজ আপডেট » আলোচিত কাক কামিনী আর কথা বলবেনা !
আলোচিত কাক কামিনী আর কথা বলবেনা !
দুদিন আগেও মা, মা বলে ডেকেছিল। আজ আর কামিনী কথা বলছে না-বলতে বলতেই চোখ ছলছল করে ওঠে খুরশিদ জাহানের। বললেন, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুধু আশাকে খুঁজছেন। আশা খুরশিদ জাহানের বড় মেয়ে। তিনি এখন ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে। তাঁকে কামিনীর অসুস্থতার খবর দেওয়া হয়নি। খবর পেলেই কাঁদতে কাঁদতে চলে আসবে। কামিনীর জন্য সবার মন খারাপ। সে প্রায় মাথা তুলতে পারছে না। তার জন্য সারা বাড়িতে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রতিবেশীরা আসছেন। কামিনীর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা কলেজের মোড়ে আশরাফ আলীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কামিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে তাঁর স্ত্রী খুরশিদ জাহান কাঁদছেন, তাতেই বোঝা যায়, কামিনী তাঁর সন্তানের জায়গা দখল করেছিল।
গত বছরও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে কামিনীর জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। ঊষা ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িভরা মানুষ-সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু কামিনী’। জন্মদিনের দাওয়াতে এসেছিল বাড়িভরা মানুষ। খুরশিদ জাহান বলেন, অতিথিদের কারও খেয়াল ছিল না কামিনী একটা পাখি। একটা কাক।
আশার মা খুরশিদ জাহান বললেন, আজ থেকে আট বছর আগে এক রাতে প্রচণ্ড ঝড় হয়। সকালে বাড়ির আঙিনায় ছোট্ট একটি পাখির বাচ্চা পড়ে ছিল। তিনি বাচ্চাটি তুলে এনে ঘরের চালার ওপরে রেখে দিলেন যাতে মা-পাখিটা এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে যায়। দুই দিন পর হঠাৎ করে তাঁর বাচ্চাটির কথা মনে পড়ে। তিনি উঁকি দিয়ে চালার ওপরে দেখেন বাচ্চাটি ঠায় বসে আছে। কাছে যেতেই বাচ্চাটি হাঁ করে। তিনি বুঝতে পারেন, দুই দিন থেকে অভুক্ত বাচ্চাটি হয়তো খেতে চাইছে। তিনি বাচ্চাটিকে ড্রপার দিয়ে তরল খাবার দিলেন। এভাবে খাইয়ে বাড়ির স্টোর রুমে রাখেন। আস্তে আস্তে শারীরিকভাবে সবল হলো কিন্তু সে আর বাড়ি ছেড়ে যায় না। ঠিক এক বছর পর তাঁরা বুঝতে পারেন যে বাচ্চাটি কাকের। এরপর বাচ্চাটি তাঁদের নানা যন্ত্রণা দিতে থাকে। কখনো গাভির দুধ বাটিতে রেখেছেন তো কাকের বাচ্চাটি চোখের পলকে দুধের বাটিতে নেমে গোসল করে উঠল। ডিম রান্না করেছেন তিনটি। হঠাৎ সে দুটি নিয়ে উধাও। বাটি ভরা তরকারি সব উল্টে ফেলে দিয়ে চলে গেল। এভাবে নানা যন্ত্রণা দিতে থাকে। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন তাঁদের সব যন্ত্রণা আনন্দে পরিণত হলো। কাকটি তাঁর মেয়েদের মতো তাঁকে আম্মু বলে ডেকে ওঠে। দুই মেয়ে ঊষা ও আশাকেও নাম ধরে ডাকে। এরপর থেকে বিরক্তিকর কাকটি বাড়ির সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। সারা দিন কাকটি নানা রকম মজাও করে। তাঁর বাচ্চারা সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করছে। ও গিয়ে চোখের পাতা ধরে টানে। পড়াশোনার সময় পাশে গিয়ে বসে থাকে। ঠিক যেন পড়তে বসেছে। ঘুমানোর সময় বিছানায় গিয়ে ওঠে। তাঁর মেয়েরা দিনের বেলায় ঘুমিয়ে গেলে কামিনী তাদের গায়ে মশা বসতে দেয় না। দিনে দিনে অ আ ক ও এক থেকে সাত পর্যন্ত গুনতে শিখে যায়।
২০১০ সালে কাকের কথা বলার খবরটি জানাজানি হলে বাড়িতে কাকটির মুখের একটা কথা শোনার জন্য অনেকেই ভিড় করেন। মানুষের ভিড় দেখে খুরশিদ জাহানের স্বামী আশরাফ আলী তাঁর বাড়িতে একটি পরিদর্শন বই খোলেন। তাতে দেশ-বিদেশের এক হাজারেরও বেশি মানুষ মন্তব্য লিখেছেন তাতে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিবপুর থেকে এসেছিলেন প্রকৌশলী তানিয়া খাঁ। তিনি লিখেছেন, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে কামিনীর নাম আসা উচিত। ময়না, কাকাতুয়ার চেয়েও কামিনীর কথা পরিষ্কার। কামিনীকে অনেক শুভেচ্ছা রইল। রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ এস এম নাহিদা লিখেছেন, ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়, তারই উষ্ণ প্রমাণ কামিনীর কথা বলাটা। অনুশীলন করলে অসাধ্য সাধন করা যায়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান লিখেছেন, কামিনীর কথা শুনে মুগ্ধ হলাম।
অসুস্থ কামিনীকে দেখে ফেরার সময় খুরশিদ জাহান বলেন, চিকিৎসক বলেছেন, বয়স হয়েছে। কামিনী আর বাঁচবে না। কামিনীর সুবাদে কত মানুষ বাড়িতে আসত। কামিনী মারা গেলে হয়তো আর কেউ আসবে না। আপনারা দোয়া করবেন, ২১ মার্চ কামিনীর জন্মদিন। ও যেন বেঁচে থাকে। ওর জন্মদিনটি যেন পালন করতে পারি। ওই দিন রাতে অফিসে ফিরে ‘কামিনীর জন্য প্রার্থনা’ শিরোনামে লিখছিলাম। রাত ১০টা সাত মিনিটের সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। কামিনীর গৃহকর্তা আশরাফ আলীর কণ্ঠ। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন, কামিনী আর নেই। ফোনের অপর প্রান্ত থেকেই শোনা যাচ্ছিল পরিবারের সদস্যদের কান্নার রোল। তখন শিরোনামটি বদলে রাখা হলো ‘কাকের জন্য এলিজি’। সূত্র - প্রথম আলো