সোমবার ● ১১ মার্চ ২০১৩
প্রথম পাতা » নিউজ আপডেট » খুনের পর খুন, দেশজুড়ে আতঙ্ক
খুনের পর খুন, দেশজুড়ে আতঙ্ক
৷৷ নিউজ আপডেট ৷৷ সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই আহমেদ মিরাজ খুন হয়েছেন। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় রাস্তার ওপর থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কুষ্টিয়ার লালন শাহ সেতুর নিচ থেকে পাওয়া গেছে পাবনার বিএনপি নেতা ইব্রাহীম আলী মৃধার মৃতদেহ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ডাকাতদের গুলিতে নিহত হয়েছেন তরুণী রেহানা আক্তার। খুলনার কয়রাতে হামলায় নিহত হয়েছেন এক পুলিশ কনস্টেবল। এসব ঘটনা গত শনিবার দিবাগত রাতের।
এর আগের দিন শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ওরফে ত্বকির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে খুন হন কলামউদ্দিন নামের এক যুবক। চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী পেয়ারুল ইসলাম। একই দিন রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র তারিকুল আলম। এখনো তাঁর খোঁজ মেলেনি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। এ ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা আদালতে খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেছেন।
এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর দেশজুড়ে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭৮ জন। এদের মধ্যে অনেকে যেমন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তেমনি জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের হামলায় আট পুলিশ সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সাধারন মানুষ নিহত হয়েছেন।
সব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় একের পর এক প্রাণহানিতে জনমনে নিরাপত্তার অভাব প্রকট হচ্ছে। একই সঙ্গে শঙ্কা ও উদ্বেগ বাড়ছে গুম, অপহরণ, ডাকাতি ও নীরব চাঁদাবাজির মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের ঘটনায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) দেশে ৬২৭টি খুন হয়েছে। অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছে ১৬৭ জন। আর ডাকাতি হয়েছে ১১৮টি। অপরাধের এ হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
দায়িত্বশীল একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে র্যাব-পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এ কারণে অপরাধ পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের শেষ সময়ে এসে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশের শিথিলতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে সরকারও উদ্বিগ্ন। গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বাস্তবে এ ধরনের কোনো অভিযানের খবর শোনা যায়নি। উল্টো পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। গতকাল রোববার রাজশাহীর বাঘায়ও আসামি ধরতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার হয় পুলিশ।
অবশ্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা মানতে চান না পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইপিজি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা ঘটছে, তাতে কোনো কিছুই ব্যাহত হচ্ছে না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মোকাবিলা নিয়ে পুলিশের ব্যস্ত থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘কোন সময় কীভাবে কাজ করতে হবে, সেটা জানাও পুলিশের দায়িত্ব। তবে এ জন্য যে লোকবলের প্রয়োজন তা পুলিশের নেই। সে কারণে হয়তো কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
খুন বেড়েছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জানান, ২০১২ সালে দেশে চার হাজার ১১২টি খুন হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১১ জনের বেশি মানুষ খুন হয়েছে। আগের বছরে এ সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৯৬৬টি। এর মধ্যে রাজনৈতিক খুন আছে ১১টি। ২০১০ সালে খুন হয়েছে তিন হাজার ৯৮৮ জন।
পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর সারা দেশে ৮৪৬ জন অপহূত হয়েছে। এর আগের বছর (২০১১) অপহূত হন ৭৯২ জন। তবে প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি বলে জানা গেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, জনমনে যখন নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তখন তা মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শঙ্কাহীন জীবনের অধিকার মানবাধিকার। এটা যখন মুখ্য হয়ে ওঠে তখন অন্য অধিকারগুলো গৌণ হয়ে যায়।
দুই বছরে দেশে গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে গাড়িচালকসহ নিখোঁজ হন বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী। বিএনপির আরেক নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন ২০১০ সালের ২৫ জুন। এঁদের কোনো খোঁজ মেলেনি।
পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে গত জানুয়ারি মাসে অপহরণের পর খুন হয়েছেন ছয় জন। এদের মধ্যে আছেন টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মজিবর খান, ঝিনাইদহে রফিকুল ইসলাম মজুমদার, টাঙ্গাইলে শিশু মারুফা। ফেব্রুয়ারি সংখ্যা জানা যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে দেশে ৭২৫ জন অপহূত হয়েছে। এর মধ্যে পাচার ও মুক্তিপণের জন্য অপহরণের ঘটনা ৮৮টি। ২০১২ সালে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই অপহূত হয় ৫৬ জন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণ ছাড়াও গত বছর ১৫০ জন নিখোঁজ হয়েছে। অপহরণের পর খুন হয়েছে ২৪ জন। এ বছরের শুধু জানুয়ারি মাসেই ২৩ জন অপহরণ ও নিখোঁজ হয়েছে। অপহরণের পর খুন হয়েছে ছয়জন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, খুন, ডাকাতি ও অপহরণকে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সেই হিসাবে বর্তমানে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সরকারের শেষ সময়ে এসে সংঘবদ্ধ অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। কিছু সন্ত্রাসী আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার সন্ত্রাস করছে। আবার অনেক সন্ত্রাসী বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছে।
৮ পুলিশ সদস্য নিহত: একজন পুলিশ সুপার বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশকে এখন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত-শিবিরের হামলায় আটজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৫৭০ জন। এ নিয়ে পুলিশের ভেতরে একধরনের ভীতি কাজ করছে। তাঁরা কঠোর হতে পারছেন না। এ ছাড়া সরকারের শেষ বছর বলে অনেকেই গা ছেড়ে দিয়েছেন। এ কারণে প্রচলিত অপরাধ দমনে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
পুলিশের সাবেক আইজি নূরুল হুদা এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সরকারের দায়বদ্ধতা আছে। যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দেবে। এখানে কোনো ধরনের গাফিলতি করা চলবে না। -প্রথম আলো অবলম্বনে