সোমবার ● ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৩
প্রথম পাতা » অনলাইন ভালোবাসা » কৈশরের প্রথম ভালোলাগা
কৈশরের প্রথম ভালোলাগা
রেল লাইন টি উত্তর দিকে চলে গেছে লালমনিরহাট পর্যন্ত। বগুড়া জেলার উত্তরের থানা শহর সোনাতলা স্টেশন থেকে দেড় কি.মি. পরেই গাইবান্ধা জেলা শুরু। উত্তর এর আউট সিগ্নাল টিও গাইবান্ধা জেলার মধ্যে। এর একটু আগেই গোপার বিল। বিল্টি পূর্বে বাঙ্গালী নদীর সাথে মিশেছে। এক দময় এ বিল দিয়ে এ এলাকার পাট যেত দুরের কোন বন্দরে। ব্যাবসায়ীদের বড় বড় বজরা আসত। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। বর্ষা ছারা এ বিল এ পানিও থাকে না। ছোট ছোট পুকুর এর মত চুয়া গুলতে বছর এর বেশ কিছু সময় পানি থাকে। আর বেশির ভাগই এখন চাষের জমি। এই বিলের পশ্চিম ধার ঘেষে রেল লাইন চলে গেছে। একটি রেল সেতুও আছে সেখানে। পাশের রাস্তা টি যখন ছিল না তখন রেল লাইনের ধার ঘেষে আইলের মত সরু রাস্তা টি ই মানুষের চলাচল এর একমাত্র রাস্তা ছিল। এখন সেতুটি বেশ নিরিবিলি।
সামনে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। খেলাধুলা আপাদত বন্ধ আছে। মাঠে যাওয়ার উপর বাড়ি থেকে এক রকম নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বিকেল্টা তাই কাটতে চায় না। আছর এর নামাজ এর পর হাতে কিছু সিট নিয়ে বেরিয়ে পরি। সিট হাতে থাকলে বাবা ভাবে হয়ত কোথাও পড়তে যাচ্ছি তাই আর কিছু বলে না। রেল লাইন এর স্লিপার এর উপর দিয়ে হাটতে হাটতে চলে আসি এ ব্রিজ পর্যন্ত। দূরে রেল লাইনের দিকে দৃষ্টি মেললে মনে হয় গাছগাছালি দিয়ে লাইন টা ধেকে গেছে। মাঝে মাঝে সে গাছগাছালি ভেদ করে ট্রেন আসে। আবার কখন এর মাঝে হারিয়ে যায়। ব্রিজের পাশেই বাধানো এক প্রশস্ত যায়গায় বসে পরি। বিকেলে পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে থাকে। রোদের তেজ তখন অনেক কম। বিলটির একটা ছোট্ট অংশ এই ব্রিজ এর নিচ দিয়ে সরু খালের মত হয়ে ফসলের মাঠের বুক চিরে, একটা জঙ্গল কে পাশ কাটিয়ে আর এক টা বিলে গিয়ে পরেছে পশ্চিমে। ঐ জঙ্গলের উল্টো দিকে একটা বাড়ি। বড়ির পাশ টা আম কাঠাল আর সুপারি বাগানে ভর্তি। সামনে একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুর এর পাশ দিয়ে একটা বড় আইল ক্ষেতে নেমে গেছে। ছোট বেক্লায় যখন আম চুড়ি করতে কয়েক জনের বিচ্ছু দল নিয়ে ঘুরতাম তখন এই যায়গাটা এরিয়ে যেতাম। কেমন ভয় ভয় লাগত।
আমার এ বৈকালিক বসার জায়গাটি র কথা এখন কেউ জানে না। ইচ্ছা করেই কাউকে বলিনি। বিকাল বেলা একদিন এখানে এসে নেশার মত হয়ে গেছে। সূর্য ডোবা পর্যন্ত প্রকৃতির নানা পরিবর্তন দেখি। মানুষ এর যাতায়াত দেখি। শান্ত ভাবে বাজার এর ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছে সুখি মানুষ গুল। আমার কৈশর এর এই বেলায় শুধু প্রকৃতি আর মানুষ দেখার জন্যই কি আমি এখানে আসি?
–না।
যে বাড়ির কথা বললাম সেই বাড়ির খোলা বড় উঠনটিতে প্রায়ই এক মেয়েকে দেখি। মেয়ে না বলে কিশোরী বলাই বুঝি ঠিক হবে। কখন সে উঠনে হাটাহাটি করে কখন চেয়ারে বসে থাকে। এত দূর থেকে শুধু তার অবয়ব টি বুঝতে পারি, জামার রঙ বুঝতে পারি মুখদেখতে পারি না। প্রথম কয়েকদিন অনিয়মিত তারপর নিয়মিতই দেখতে থাকি। ছোট্ট এ জীবনে মেয়েদের ব্যাপার গুল নিষিদ্ধ ছিল। ভাব্লেও কেমন জানি ভয় ভয় লাগে। কিন্তু এ কয়দিনের এ মেয়েটি কে নিয়ে যে অনুভুতি সেটা সম্পুর্ন আলাদা। কি সেটা আমি বর্ননা করতে পারব না।
হয়ত একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পারি, একটু বেশি সাহস করে হয়ত কথাও বলা যায় কিন্তু এ মন সায় দেয় না। যদি কাছে গেলে হারিয়ে যায়? আর কখন না আসে। না না এই ভাল।
ওদের বাড়িটার পেছনেই যেন সূর্য ডুব দেয়। তাই তারাতারি অন্ধকার হয়ে যায় ও দিকটা। ও বেশিক্ষন থাকেও না। আমি এসে অপেক্ষা করি। রাস্তার মানুষ দের কথা বার্তা, ছোট বাচ্চা দের চেচামেচি সব কিছু যেন বিরক্ত লাগে। আসছে না কেন? কোথাও কি গেছে? অসুখ করেনি ত? এমন হাজারটা চিন্তা করি অকে না দেখা পর্যন্ত। হঠাৎ যেই গেট খুলে বেরিয়ে আসে উচ্ছল হরিনির মত অমনি সব চিন্তা হারিয়ে যায়। আশেপাশের আওয়াজ সব দূরে কথাও মিলে যায়। আমি কথা বলি ওর সাথে। সবই অবশ্য মনে মনে।
আমি জিজ্ঞেস করি এত দেরি করলে যে?
সে উত্তর দেয় কোথায় দেরি করলাম?
আমি বলি কখন থেকে বসে আছি……………
সে বলে তাই বুঝি?
ও হাসে আমি সে হাসির আওয়াজ শুনতে পাই। আরো কত কথা বলি তার ঠিক নাই।
বিকেলের আলো ইস্তিমিত হওয়ার আগেই সে চলে যায় বিকেল টা কে সন্ধ্যা বানিয়ে। আমি তবুও বসে থাকি, আবার যদি আসে সেই আশায়। অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত আমি বসেই থাকি। ভাবি, ও কি জানে আমি ওর জন্যই আসি? ও কি জানে অর জন্য একটি কিশোর দুষ্টু ছেলে শান্ত হয়ে এখানে বসে?
পরের বিকেলের অপেক্ষায় আমি রেল লাইন ধরে হাটতে থাকি। কোন একদিন তাকে দেখতে পাই না। সেদিনের বিকেল যেন অনেক দীর্ঘ হয়। শত শত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। ফিজিক্স এর সূত্র গূল সব উল্টে যায়। অজানা অভিমানে মনটা ভরে যায়।
পরদিন যখন আসে তখন আমি ঠোট ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বলি না দেখবনা।কিন্তু তাই কি হয়? চোখ যে ঘুরেফিরে ওর দিকেই চলে যায়। সে বলে,
–বাব্বাহ এত অভিমান।
আমি লজ্জা পেয়ে বলি
–না……………
সে বলে গোমড়া মুখে থাকলে আমি কিন্তু চলে যাব।
আমার অভিমান গ্যাস হয়ে সব উরে যায়। মনের মাঝে খুব সুখের এক অনুভুতি দোলা দিতে থাকে।
একদিন ওর সাথে আর এক মেয়ে কে দখতে পাই। হোঠাৎ করে মনে হয় ইস এই মেয়েটার জন্য আজ কথা বলতে পারবনা। প্রচণ্ড রাগ হয় এই আগুন্তুক মেয়েটির উপর। ওরা হাসছে কথা বলছে সব ই শুনতে পাচ্ছি যেন আমি। আমার আর ওর মাঝের এই মেয়েটি কে অসহ্য লাগতে শুরু করে। হঠাৎ দেখি ওরা পুকুর পারের আইল দিয়ে নেমে আসছে। বুকের মাঝে ছ্যাত করে ওঠে। কই আসছে ওরা? এদিকে না ত?
আমার বুকের মাঝের হৃদ স্পন্দন স্পষ্ট সুনতে পাচ্ছি। এখানে আমাকে দেখে কি ভাববে? আমার কি চলে যাওয়া উচিৎ? যদি খারাপ ছেলে ভাবে? নানা চিন্তা মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছে। ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা বাতাসেও আমি ঘামতে শুরু করেছি।
ও আজ সবুজ রঙ এর একটা জামা পরেছে। ক্ষেতের সবুজ আর জামার সবুজ একাকার হয়ে ও যেন প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। একেবেকে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে ওরা এগিয়ে আসছে। মনের একটা অংশ বলছে আমাকে চলে যেতে, কিন্তু অন্যান্য অংশ গুলো তাকে ধমক দিয়ে আমাকে সেখানে বসিয়ে রেখেছে। ও এগিয়ে আসছে আর আমার হৃদ স্পন্দন যেন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে।
অবশেষে ক্ষেতের সবুজ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে তার সখি টির হাত ধরে সে লাইনে উঠে আসল। এত দিন যাকে দূর থেকে দেখেছি তাকে স্পষ্ট দৃষ্টি সীমায় পেয়েও তার দিকে তাকানর সাহস হারিয়ে ফেলেছি। হৃদস্পন্দন থেমে গিয়ে যেন শো শো শব্দ শুনতে পাচ্ছি। না তাকিয়েও বুঝতে পারছি ওরা দুজন লাইনের উপর দিয়ে হাত ধরে ব্রিজের দিকে এগিয়ে আসছে।আমি যেন পাথর হয়ে গেছি। আমার হাত থেকে একটি সিট পানিতে পরে গেল আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওরা কাছে চলে এসেছে, এইত আমি সেই পরিচিত হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি কি মাথা ঘুরিয়ে তাকাব তার দিকে? কিন্তু মাথা ঘোরাতে পারছি না। ঘারটা যেন শক্ত হয়ে গেছে। ট্রেনের তিব্র হুইসেলে আমার ঘোর কিছুটা ভাংল। আমি দাড়িয়ে লাইন থেকে কিছুটা সরে আসলাম। আড় চোখে শুধু দেখলাম ওরা লাইন এর আর এক পাশে চলে গেল। আমাদের মাঝদিয়ে সাম্নের স্টেশন এর দিকে যাওয়া ট্রেন টি হুইসেল বাজিয়ে যেতে থাকল।
ট্রেনের দুই বগি র মাঝদিয়ে আমি তাকিয়ে এক পলক ওকে দেখতে পেলাম। তার পর আর একটা বগি পার হওয়ার দীর্ঘ বিরতি। আবার ফাকা অংশ আসলে আবার দেখলাম। তার পর আবার। এভাবে ট্রন চলে যাওয়া পর্যন্ত তাকে কয়েক পলক দেখেছি। ট্রেন টি আরও বড় হলে কি এমন ক্ষতি হত?
কয়েক পলকের দেখায় তাকে মনে হয়েছিল সে যেন আমার জন্ম জন্মান্তরের চেনা।
লিখেছেন-সৈকত খান
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার (ইঞ্জিন ক্যাডেট)