শনিবার ● ৭ জুলাই ২০১২
প্রথম পাতা » খোলা কলম » নতুন বিতর্কে ‘ঈশ্বর কণা’
নতুন বিতর্কে ‘ঈশ্বর কণা’
সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আসলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে পদার্থবিদ্যার তত্ত্বকে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ বলে। এর অর্থ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকে কোনো অদৃশ্য ভর নিয়ন্ত্রণ করে বা বস্তুর ভারসাম্য অবস্থায় রাখে।
কিন্তু এ তত্ত্বের পেছনে অনেকগুলো স্বাভাবিক যুক্তি এসে যায়। কোনো দৃশ্যমান বস্তুর গাণিতিক ভর কেন অদৃশ্য ভরের ওপর নির্ভরশীল। আর তা কিভাবেই বা দৃশ্যমানের সঙ্গে অদৃশ্যমান ভরের সমন্বয় করে। তাহলে এ দুটি ভর কি ভিন্ন। নাকি অভিন্ন। ভিন্ন হলে তা কতটা ভিন্ন। আর অভিন্ন হলে তা কিভাবে অদৃশ্যমান আচরণ করে।
মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তু ভরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ ভর কোথা থেকে আসে। এর সৃষ্টি-ই বা কোথায়। আর কোথায়-ই বা তা মিলিয়ে যায়। আর এসবের সদুত্তর জানতে পদার্থবিজ্ঞানে আসে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ তত্ত্ব।
এ তত্ত্বেও রহস্য নিয়ে কাজ শুরু করেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস। ১৯৬০ সালে হিগস এ অদৃশ্য ভরকে (গড পার্টিকলস) বা মহাবিশ্ব সৃষ্টির ‘ঈশ্বর কণা’ বলে অভিহিত করেন।
পরে পিটার হিগসের সঙ্গে উপমহাদেশের ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এ কণার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেন। এ দুই বিজ্ঞানীর নাম থেকেই ‘হিগস-বোসন’ কণা তত্ত্বের সৃষ্টি। আজ ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত।
এতদিন ‘হিগস-বোসন’ কণার অবস্থান ছিল পদার্থবিদ্যার অপ্রমাণিত গাণিতিক সমীকরণে। কিন্তু এ অদৃশ্য ভর ছাড়া মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তুর স্বাভাবিক উপস্থিতি এবং আচরণ সত্যিই অলৌকিক। একে অলৌকিক তত্ত্ব ব্যাখ্যার আর কোনো ভাষা পদার্থবিদ্যায় ছিল না। তাই একে অনেক বিজ্ঞানী ‘ঈশ্বর কণা’ বলেই অভিহিত করেন।
৪ জুলাই, ২০১২। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সত্যিই মাইলফলকের একটি দিন। কারণ মহাজাগতিক সৃষ্টি রহস্যেয় একটি নতুন কণার ঝলক আবিষ্কারের দিন। আর তা মাত্র ১ সেকেন্ডের ১ লাখ ভাগের ১ ভাগের সময়ের জন্য দৃশ্যমান হয়।
সার্নের মহাপরিচালক রিলফ হওয়ে বলেন, এ কণা নিয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তবে হিগস-বোসন তত্ত্বের প্রায় ফিকে হয়ে যাওয়া অনুমান এখন বাস্তবিক দিকনির্দেশনা পেয়েছে। এটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির গবেষণায় অনুপ্রেরণা হবে। আর হিগস-বোসন তত্ত্বে পাওয়া ‘ঈশ্বর কণা’ রহস্য উন্মোচন এখনও দীর্ঘ গবেষণার উপাত্ত। এ অর্জন ঐতিহাসিক। কিন্তু সুদীর্ঘ গবেষণার সূচনা উপাত্ত মাত্র।
ইউরোপিয়ান অরগেনাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চে (সার্ন) অবশেষে ঈশ্বর কণা তত্ত্বের একটা নজির বিজ্ঞানীদের সামনে ধরা দিল। এ গবেষণায় বিজ্ঞানীর সামনে আরও কয়েকটি কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এটি হিগস বোসন তত্ত্বের কণার শর্ত পূরণ করে কি না তা একেবারেই সুনিশ্চিত করা।
আবির্ভূত এ কণাটির সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড মডেল তত্ত্বের কতটা মিল-অমিল আছে তা খতিয়ে দেখা। আর এটি শুধু একটি অতিপারমাণবিক কণা কি না। এমন প্রশ্নের সদুত্তর থেকেই হয়ত মিলবে আরও নতুন তত্ত্ব।
কিংবা ঈশ্বর কণা নামে খ্যাত মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই অদৃশ্য ভরশক্তি। যা এ বিশ্বকে স্বাভাবিক এবং মহাকাশের কোটি কোটি গ্যালাক্সির ভারসাম্যকে একটি সুনির্দিষ্ট গোলচক্রে আবদ্ধ রেখেছে। তবে এ রহস্যের জাল এত সহসাই পদার্থবিজ্ঞানে ধরা দেবে না।
এমনটা নিশ্চিত করেছেন খোদ সার্নের জ্যেষ্ঠ গবেষকেরা। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ গবেষণায় আপাতত দিকনির্দেশনামূলক প্রমাণ নিয়েই বিজ্ঞানীদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
হিগস বোসন তত্ত্বের হিসাবে অদৃশ্য এ কণার ভর ১২৬ গিগাইলেকট্রন ভোল্টস (গেভ)। এটি একটি প্রোটন কণার তুলনায় ১৩০ গুণ বেশি শক্তিশালী। এ কণার সম্পর্কে এখনই পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করেনি সার্ন। তবে ‘অ্যালাস’ এবং ‘সিএমএস’ নামে দুটি যন্ত্রের ফলাফলে অচিরেই আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে।
অ্যালাস হচ্ছে প্রোটন সংঘর্ষের পর নতুন এবং শক্তিশালী কণা শনাক্তকরণ যন্ত্র। এখানেই প্রোটন কণার সংঘর্ষের পর সৃষ্ট সব আলোক কণার গতি সামান্য দৃশ্যমান হয়।
আর সিএমএস হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী একটি চৌম্বক গোলক। এখানে প্রোটন সংঘর্ষে সৃষ্ট প্রতিটি কণাকে চৌম্বক শক্তির মাধ্যমে টেনে নিয়ে তাকে কম্পিউটারে শনাক্ত করা হয়। এটি দুটি গবেষণা যন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল সার্ন এখনও প্রকাশ করেনি।
এ মুহূর্তে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে আলোচিত ঈশ্বর কণার অনুসন্ধান চালানো হয় ফ্র্যান্স-সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে ১০০ মিটার মাটির নিচে সুরঙ্গ খুঁড়ে ১৬ মাইল দীর্ঘ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি) গোলক গবেষণাকেন্দ্রে। গত পাঁচ দশক ধরে ঈশ্বর কণার অনুসন্ধানে বিশ্বের হাজারো পর্দাথবিজ্ঞানী নিরলস কাজ করছেন। এর মধ্যে হিগস আর বোসনের নামটাই এসেছে সবার আগে।
বিশ্ব সৃষ্টি রহস্যের এ পদার্থবিজ্ঞান জয়ের মহাযজ্ঞ গবেষণায় গত ১৮ মাসের মধ্যে গত ৪ জুলাই (২০১২) লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার গবেষণাকেন্দ্রে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন নতুন পথের দিশা। আর জেনেছেন এতদিনের গবেষণা ভুল ছিল না। তবে ‘ঈশ্বর কণা’ বলে কথা। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যে এটি সঠিক পথের সূচনা মাত্র। এমনটাই বললেন বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের শীর্ষ সব গবেষকেরা।