রবিবার ● ২৭ অক্টোবর ২০১৯
প্রথম পাতা » আইসিটি শিল্প ও বানিজ্য » টেলিযোগাযোগ খাতে জটিলতা
টেলিযোগাযোগ খাতে জটিলতা
বকেয়া পাওনা আদায় নিয়ে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে একদিকে গ্রাহকসেবার মান কমেছে, তেমনি সংশ্নিষ্ট দেশীয় ও বিদেশি সহযোগী সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েছে; যার পরিমাণ প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগও আটকে আছে। এসবের প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারেও। খবর সমকালের।
সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে গ্রামীণফোন ও রবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর পরিস্থিতি উন্নয়নের নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বৈঠকে উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ দ্রুত এ সংকট নিরসনে সংশ্নিষ্টদের নির্দেশনা দেন। এ বৈঠকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া অংশ নেন।
প্রসঙ্গত, বকেয়া পাওনা টাকা আদায় করতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি দুই শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির ক্ষেত্রে সব রকম ‘অনাপত্তিপত্র’ দেওয়া বন্ধ রেখেছে গত ২২ জুলাই থেকে। এ দুই অপারেটর-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এ কারণে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কোনো কিছু গত আড়াই মাসে করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি বেস ট্রান্সসিভার স্টেশনে (বিটিএস) কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে তা দূর করার জন্য যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের কাজও করা সম্ভব হয়নি।
বিটিআরসি ‘অনাপত্তিপত্র’ দেওয়া বন্ধের ফলে টেলিযোগাযোগ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে- অপারেটরদের এমন বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আসলে যে যার মতো করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছে। সরকারের পুরো পরিস্থিতির ওপর নজর রয়েছে। যেটা পাওয়া যাবে, জনগণের টাকা। সব বিষয় বিচেনায় রেখেই বিষয়টি সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে- এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনা পাওয়া গেলে সে অনুযায়ীই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিতে ‘নেতিবাচক প্রভাব’ :দুই অপারেটরের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ‘এনওসি’ বন্ধের ফলে বিপুল পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ আটকে গেছে। কয়েক দিন আগে গ্রামীণফোনের তৃতীয় প্রান্তিকের ব্যবসায়িক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় প্রতিষ্ঠানটির সিইও মাইকেল প্যাট্রিক ফোলি বলেন, নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন বা এনওসি দেওয়া বন্ধ থাকায় গ্রামীণফোনের ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে। প্রশ্নের জবাবে গ্রামীণফোনের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো বক্তব্যে বলা হয়, বিটিআরসির বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ডাটা নেটওয়ার্ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে বিটিআরসির নিষেধাজ্ঞা আরোপ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রয়াসের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এর ফলে তৃতীয় প্রান্তিকে পরিকল্পনার তুলনায় গ্রামীণফোনের বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে।
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম গত তিন মাসে ক্রমাগত কমতে দেখা গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৩১ মার্চ গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম ছিল ৪০৯ টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত এ দর ৪০০ টাকার কাছাকাছি অবস্থানে সামান্য ওঠানামা করে। ৩০ জুনে এসে দর নেমে আসে ৩৬৫ টাকায়। এর পর থেকে দর আরও পড়তে থাকে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে শেষ মুহূর্তে এর দর ছিল ৩২২ টাকা ৭০ পয়সা।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স সাহেদ আলম জানান, বিটিআরসির এনওসি বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে রবিতে এ বছরের জন্য বরাদ্দ প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া রবির ৪.৫জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও এখন বন্ধ। ফলে সার্বিকভাবে টেলিযোগাযোগ সেবার মান নিশ্চিত করে সেবা দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রবির মুনাফা করার সম্ভাবনাও ‘এনওসি’ বন্ধ এবং নতুন কর ব্যবস্থাপনার কারণে ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। এর ফলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্প্রসারণে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
একটি সূত্র জানায়, বিটিআরসির সিদ্ধান্তের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রবি ও জিপিকে নেটওয়ার্ক সেবা দেওয়া দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। রবি ও জিপিকে নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিটিআরসির ‘অনাপত্তি প্রদান’ বন্ধের কারণে নিয়মিত ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিবেচনায় গত আড়াই মাসে তারা প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় এক হাজার ২৭৫ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ, এ সময়ে কোনো ধরনের নতুন যন্ত্রপাতি সরবরাহ কিংবা প্রতিস্থাপনের কাজ করা সম্ভব হয়নি।
একই সঙ্গে যন্ত্রপাতি স্থাপন-প্রতিস্থাপনসহ কারিগরি সেবা ব্যবসায় যুক্ত সাত-আটটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানও প্রায় শতকোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। এ কর্মকর্তা জানান, প্রকৃতপক্ষে বিটিআরসির সিদ্ধান্ত বৃহৎ পুঁজির দুই অপারেটরের যতটা ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে কম পুঁজির ছোট ছোট সহযোগী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বেশি ক্ষতি করেছে।
সমাধানের উদ্যোগ :সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দুই অপারেটর কোনোভাবেই বিটিআরসির অডিটকে গ্রহণযোগ্য বলতে রাজি নয়। এ কারণে তারা কোনো ধরনের অর্থ পরিশোধ করতে চাচ্ছে না। কারণ, পাওনার অংশবিশেষ পরিশোধ করলেও সেটা আইনের চোখে অডিটকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিটিআরসি চায়, অপারেটররা একটা অংশ হলেও বকেয়া পরিশোধ করুক। কারণ, দুই অপারেটর একটা অংশ পরিশোধ করলে আইনগতভাবে এই অডিটকে সঠিক প্রমাণ করতে পারবে বিটিআরসি। সর্বশেষ এই জটিলতার ভেতরেই সমাধানের উদ্যোগ আটকে আছে।