বৃহস্পতিবার ● ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » এনআইডি জালিয়াতি, সব রহস্য সাত ল্যাপটপে
এনআইডি জালিয়াতি, সব রহস্য সাত ল্যাপটপে
রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাওয়ার সব রহস্য লুকিয়ে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে ফেলা সাত ল্যাপটপে। লাইসেন্স করা এসব ল্যাপটপে রয়েছে বিশেষ পাসওয়ার্ড। এ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই ভোটার নিবন্ধন তথ্য আপলোড করা হতো নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে ইসির চারটি ল্যাপটপ হারিয়েছিল। বিভিন্ন সময় হারিয়েছিল তাদের আরও তিনটি ল্যাপটপ। হারিয়ে যাওয়া এসব ল্যাপটপই ব্যবহার করেছে জালিয়াত চক্র। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে এর দুটি এরই মধ্যে উদ্ধার হলেও এখন পর্যন্ত হদিস মেলেনি অপর পাঁচটির। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ধারণা, হারিয়ে যাওয়া সব ল্যাপটপ উদ্ধার হলে খুলবে অনেক জট। মিলবে অনেক প্রশ্নের উত্তর। শনাক্তও করা যাবে এ চক্রের সবাইকে। খবর সমকালের।
এদিকে, বিশেষায়িত ল্যাপটপ এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পরও নিষ্ফ্ক্রিয় থাকায় ইসির ১৫ কর্মকর্তাসহ ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছে দুদক। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদেরও জালিয়াতির এ ঘটনায় যোগসাজশ আছে। তবে ইসিতে জালিয়াত চক্রের এভাবে শেকড় গাড়ার নেপথ্যে দায়ী করা হয়েছে সাবেক সচিব স ম জকরিয়াকে।
এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্তদের বেশির ভাগকে তিনিই চাকরি দিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখও করেছে দুদক।
জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মাহমুদ হাসান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের ভোটার ও পাসপোর্ট করা সম্ভব নয়। তাদের কে কীভাবে দায়িত্ব অবহেলা করেছে, সেটি উল্লেখ করে আমরা প্রতিবেদন পাঠিয়েছি ঢাকায়। পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে সেখানকার নির্দেশনা অনুযায়ী।’ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা স্বীকার করে গত সোমবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনে কথা বলেছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘দুটি তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রাথমিক তথ্যে ইসির অন্তত ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে। সন্দেহভাজন সবাইকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যে সাতটি ল্যাপটপ হারিয়ে গেছে, তার মধ্যে দুটি উদ্ধার হয়েছে। আমাদের মূল ডাটাবেজ সুরক্ষিত আছে। যারা এখানে ঢোকার অপচেষ্টা করেছিল, তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তবে যারা এ অপচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ তবে সার্ভারে প্রবেশের জন্য ইসির নির্ধারিত পাসওয়ার্ড ও মডেম থাকতে হয় বলে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপগুলো দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করা সম্ভব নয় বলে দাবি করেন তিনি।
লাকি আকতার নামে এক রোহিঙ্গা নারী সম্প্রতি ভুয়া এনআইডি সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে পাসপোর্ট নিতে গিয়ে ধরা পড়েন। এর কয়েক দিন আগে কক্সবাজারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদ। এ সময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় নির্বাচন কমিশনের একটি স্মার্টকার্ড। পরপর এ দুটি ঘটনায় সামনে আসে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার ইস্যু। বিষয়টি নিয়ে দুদক তদন্তে নামলে বের হয়ে আসে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সাত ল্যাপটপের দুটি উদ্ধার হলেও হদিস নেই পাঁচটির :নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, ২০০৭-০৮ সালে ব্যবহূত কিছু অকেজো ল্যাপটপ নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় ওই ল্যাপটপের সঙ্গে ভুলে চলে যায় নির্বাচন কমিশনের অন্তত পাঁচটি বিশেষায়িত ল্যাপটপ। আবার ২০১২ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকেও কমিশনের বিশেষায়িত দুটি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এসব ল্যাপটপ ব্যবহার করে জালিয়াত চক্র ভোটার করে আসছিল রোহিঙ্গাদের। হারিয়ে যাওয়া সাতটি ল্যাপটপের মধ্যে দুটি সম্প্রতি উদ্ধার করেছে চট্টগ্রামের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকে গ্রেফতার করে একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করে পুলিশ। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয় ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয় মোস্তফা ফারুক নামে নির্বাচন কমিশনে কাজ করা আরেক অস্থায়ী কর্মীর কাছ থেকে। তিনি বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে হারিয়ে যাওয়া অপর পাঁচটি ল্যাপটপের এখনও হদিস মেলেনি।
ইসির কর্মকর্তারা যেভাবে ‘সহযোগী’ হয়েছেন জালিয়াতিতে :দুদক প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো এনফোর্সমেন্ট টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের বিশেষায়িত ল্যাপটপ স্পর্শকাতর হলেও এ অভিযানের আগে ল্যাপটপ হারানো-সংক্রান্ত কোনো জিডি/মামলা করেনি কমিশনের কেউই। এমনকি ল্যাপটপ উদ্ধারের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। আবার কক্সবাজারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নুর সর্দার স্মার্টকার্ড পেলেও নির্বাচন কমিশন অফিসের সার্ভারে ছিল না এ-সংক্রান্ত আপলোডকৃত তথ্যের হার্ডকপি। অথচ ২০১৬ সালে নির্বাচন কমিশন পাঁচলাইশ কার্যালয়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন লতিফ শেখ। ডাকাত সর্দার নুর আলম ল্যাপটপ নং ১৫৫৭-৪৩৯১ ব্যবহার করে ২০১৫-১৬ সালের হালনাগাদে ভোটার হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কাছে পাঠানো এক পত্রে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান উল্লেখ করেন, ১৫৪১-৪৩৯১ নম্বরের ল্যাপটপ/ডেস্কটপ চট্টগ্রাম জেলায় ব্যবহূত হয় না। নির্বাচন কমিশনের বিশেষায়িত এ ল্যাপটপটি ২০১৪ সালে হারিয়ে গেছে। দুদকের প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৪ সালে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপটি দিয়ে তাহলে কীভাবে ২০১৫-১৬ সালে হালনাগাদ তালিকায় ভোটার করা হলো রোহিঙ্গা ডাকাত নুর সর্দারকে। জালিয়াত চক্রের সঙ্গে তাই নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে বলে বর্তমান ও সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদেরও সম্পদ বিবরণী যাচাইয়ের অনুমতি চেয়েছে দুদক। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তথ্য আপলোড দেওয়ার ক্ষেত্রে ল্যাপটপের বাইরে ডিজিটাল ক্যামেরা, স্ক্যানার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন, আইরিশ মেশিন, ডিজিটাল সিগনেচার প্যাডসহ এনআইডিতে ব্যবহূত ডিভাইসগুলো কোনো কর্মচারীর কাছে থাকার কথা নয়। ভোটার ফরম-২ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি সংরক্ষিত এবং সিরিয়ালভিত্তিক ফরম। এক উপজেলার ফরম দিয়ে অন্য উপজেলার ভোটার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার এ ধরনের ফরম বিতরণের সময় নিয়ম অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা হিসেবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার স্বাক্ষর করার কথা। কিন্তু বাঁশখালীতে যেসব রোহিঙ্গা অন্য উপজেলার ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার নম্বর পেয়েছে, তাদের সবার সিরিয়াল নম্বর ছিল ৪১৮৬৬৩৩৩ থেকে ৪১৮৬৬৩৯৩-এর মধ্যে। এ ৬০ ফরমের কোনোটিতেই জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। ফ্ল্যাক্সিবল সিলের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছিল এ সিরিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ ফরমগুলো। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকাতেই স্বাক্ষরবিহীন এসব ফরম দিয়েই বাঁশখালী থেকে ভোটার হয়েছে ৬০ জন। এসব কারণে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদেরও এনআইডি জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
জালিয়াত সিন্ডিকেটের বেশির ভাগকেই ইসিতে চাকরি দিয়েছেন সাবেক সচিব :রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় দুটি সিন্ডিকেটে অন্তত ১৫ জনের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে শাহানুর মিয়ার সিন্ডিকেটে আছে তার আট থেকে ১০ জন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। জয়নাল আবেদীনের সিন্ডিকেটেও আছে তার ছয় থেকে সাতজন নিকটাত্মীয়। ইসির সাবেক সচিব (ভারপ্রাপ্ত) স ম জকরিয়া অন্যায় সুবিধা নিয়ে তাদের বেশির ভাগেরই চাকরি দিয়েছেন বলে দুদক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। দুই পরিবারের এত মানুষকে নির্বাচন কমিশন অফিসে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান আইপিএলের কর্মকর্তা দ্বিজেন দাশও আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে।