বৃহস্পতিবার ● ২৯ আগস্ট ২০১৯
প্রথম পাতা » আইসিটি শিল্প ও বানিজ্য » এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার ১২ প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছে বিআরটিএ
এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার ১২ প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছে বিআরটিএ
রাজধানীতে এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার জন্য ১২ প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। ২০১৫ সালে অনলাইন ভিত্তিক যাত্রীসেবা শুরুর প্রায় চার বছরের মাথায় বৈধতা পেল এসব প্রতিষ্ঠান। যদিও এখনও অন্তত ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই রাজধানীতে যাত্রীসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বৈধতা পেতে বিআরটিএ বরাবর আবেদন করেছে; যা যাচাই-বাছাই ও শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তালিকাভুক্তির কথা বলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।খবর জনকণ্ঠের।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, যেসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তালিকাভুক্তির আবেদন করেছে তাদের গাড়ির সংখ্যা চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো আনুমানিক দেড়লাখ যানবাহন দিয়ে যাত্রীসেবা পরিচালনা করছে। তাছাড়া লাইসেন্স প্রক্রিয়া শুরু হলেও যাত্রী নিরাপত্তায় সার্বিক কার্যক্রম এখনও শুরু করতে পারেনি বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। কোম্পানির অনুমোদন হলেও গাড়ির এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
সূত্র বলছে, রাজধানীতে এ্যাপভিত্তিক যাত্রীসেবায় নিয়োজিত প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের বেশিরভাগই একাধিক প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। দ্রুত ভাড়া পেতে একই সঙ্গে একাধিক কোম্পানির এ্যাপ ব্যবহার হচ্ছে। এক কোম্পানির হয়ে ভাড়া পাওয়ার পর অন্য প্রতিষ্ঠানের এ্যাপ বন্ধ থাকে। যাত্রী নামানো শেষে আবারও একাধিক এ্যাপ সচল হয়। এতে চালকরা লাভবান হচ্ছেন বেশি।
আর এ্যাপভিত্তিক কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, শহরে গাড়ির সংখ্যা কম। রাস্তাও কম। দিনভর যানজট থাকায় ইচ্ছা করলেই নতুন নতুন পরিবহনের অনুমোদন পাওয়া কঠিন। এই প্রেক্ষাপটে চালকরা একাধিক প্রতিষ্ঠানে গাড়ি তালিকাভুক্ত করাচ্ছেন। বিষয়টি আমরা জানলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এই মুহূর্তে করণীয় কিছু নেই।
ঢাকায় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি রাইড শেয়ারিং সেবা শুরু হয়। ওই বছরের মে মাসে দেশী প্রতিষ্ঠান ‘চলো’র যাত্রা শুরু। এক বছর পর ‘১৬ সালের মে মাসে ‘স্যাম’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। একই বছরের নবেম্বরে ঢাকায় যাত্রা শুরু করে বিশ^ব্যাপী জনপ্রিয় এ্যাপভিত্তিক যাত্রীসেবা প্রতিষ্ঠান ‘উবার’। ডিসেম্বরে আসে ‘পাঠাও’।
যাত্রা শুরুর পর পরই প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার বৈধতা নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হয়। বিআরটিএ শুরুতে অনুমোদনহীন সেবা প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। পরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে প্রাথমিক যাত্রীসেবার অনুমতি দেয়া হয়। জনচাহিদার চাপে ‘১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটি রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা প্রণয়ন করে। মার্চে কাগজেকলমে এই নীতিমালা কার্যকর হয়। নীতিমালা অনুসারে, রাইড শেয়ারিং কোম্পানি এবং তাদের চালানো যানবাহন আলাদাভাবে বিআরটিএর অনুমোদন প্রয়োজন। এটাকে বলা হচ্ছে ‘এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট’। নীতিমালা প্রণয়নের পরই ষোলোটি কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। আবেদনে ত্রুটি থাকায় সব শর্ত পূরণ করে জমা দিতে কোম্পানিগুলোর আবেদন ফেরত পাঠানো হয়। প্রাথমিক হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানের আওতায় প্রায় দেড় লাখ যানবাহন চলছে মহানগরীতে।
সরকার ও রাইড শেয়ারিং কোম্পানির সূত্র বলছে, কোম্পানিগুলো তাদের সুবিধামতো বিআরটিএর নিবন্ধন চায়। বিআরটিএও চাইছে এই খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ‘১৭-এর তিনটি ধারা এবং পুলিশের দুটি আপত্তিতেই সব আটকেছিল অনেকদিন। তারপর এসব সমস্যা সমাধানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়েছে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে।
বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, এতদিন নিবন্ধন না থাকায় রাইড শেয়ারিং সেবায় পুলিশের ‘৯৯৯’ কল করে যে সেবা পাওয়ার কথা, তাও পুরোপুরি পাচ্ছেন না যাত্রীরা। যাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়লে চালকের সব তথ্য এবং যাত্রীর অবস্থান সরাসরি পুলিশের কাছে চলে যাওয়ার কথা। এর জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভা-ারের সঙ্গে চালকের তথ্য যুক্ত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন না থাকায় এর কোনটাই এতদিন সম্ভব হয়নি। এখন আস্তে আস্তে এসব বাধা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।
এদিকে রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ চিঠি দিয়ে বিআরটিএকে তিনটি সুপারিশ করে। এগুলো হচ্ছে ১০ বছরের পুরান যানবাহন রাইড শেয়ারিং সেবায় নিয়োজিত না করার বিধান, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ কত যানবাহন নিবন্ধন করতে পারবে, তা ঠিক করে দেয়া এবং শুধু ঢাকা মহানগর থেকে নিবন্ধন নেয়া যানবাহনই কেবল এ সেবায় যুক্ত হতে পারবে, তা নিশ্চিত করা।
পুলিশ বলেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জরাজীর্ণ ও পুরনো কার-মোটরসাইকেল মেরামত করে ঢাকায় রাইড শেয়ারিংয়ে যুক্ত করা হচ্ছে। ঢাকায় ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের কাজের জন্য মূল সড়কের প্রশস্ততা কমেছে। রাইড শেয়ারিং চালু হওয়ার পর ছোট যান বেড়ে গেছে, যা যানজট সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া অদক্ষ চালকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যেতে পারে। তাই কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ কত যানবাহন চালাতে পারবে, এর একটা সিলিং থাকা উচিত।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, সিএনজিচালিত অটোরিক্সার সিলিং ঠিক করে দেয়ায় যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় এই খাতে নৈরাজ্য লেগেই আছে। নীতিমালার গলদে সরকার কয়েকবার চেষ্টা করেও ট্যাক্সিক্যাব সেবা চালু রাখতে পারেনি। এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও কার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই। তাই রাইড শেয়ারিংয়ে কৃত্রিম বাধা তৈরি করে রাখার কোন অর্থ হয় না।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানি ও গণপরিবহন ॥ এ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সেবা দিচ্ছে বা দিতে চায় এমন ১৬ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য বিআরটিএতে প্রথমে আবেদন করে। এর মধ্যে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম, রাইডার, রাইডশেয়ার এন্টারপ্রাইজ ইনক ও গোল্ডেন রেন লিমিটেড যানবাহনের সংখ্যা জানায়নি। সবচেয়ে বেশি যানবাহন আছে পাঠাও, সহজ, ও ভাই সলিউশন, উবার, পিকমি ও হোস্ট ইন্টারন্যাশনালের। মোটরবাইক আছে ১ লাখ ৪ হাজার ৩৮৯, কার ১৮ হাজার ২৫৩। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ যানবাহন এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার সঙ্গে যুক্ত।
ঢাকায় ১৪ লাখের বেশি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের মধ্যে প্রায় সাত লাখ মোটরবাইক চলছে। এর একটা বড় অংশ এখন এ্যাপভিত্তিক যাত্রীসেবায় নিয়োজিত। সব মিলিয়ে কত পরিবহন এ সেবায় যুক্ত, তা কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন ছাড়া নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী রাজধানীতে প্রায় ১৪ হাজার বাস ও মিনিবাস আছে। কাগজপত্রে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। সাড়ে তিন হাজারের বেশি ট্যাক্সিক্যাব বিআরটিএর কাগজপত্রে উল্লেখ থাকলেও খুব একটা চলতে দেখা যায় না। এসব যানবাহনের জন্য আইন, নীতিমালা আছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবায় মানুষ উপকার পাচ্ছে। তবে কিছু কিছু অভিযোগও আসছে। এগুলোর সমাধান দেয়ার মতো আইনী ও সাংগঠনিক কাঠামো নেই সরকারের। সরকারের ভুল নীতির কারণে বাস-মিনিবাস, ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজিচালিত অটোরিক্সা খাতে নৈরাজ্য চলছে।
বৈধতা পেল ১২ প্রতিষ্ঠান ॥ বিআরটিএ বলছে, ১ জুলাই থেকে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেয়া শুরু হয়। প্রায় দুই মাসে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে গাড়ি পরিচালনায় বৈধতা দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, পিকমি লিঃ, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিঃ, ও ভাই সলিউশন লিঃ, চালডাল লিঃ, পাঠাও লিঃ, ইজিয়ার টেকনোলজিস লিঃ, আকাশ টেকনোলজিস লিঃ, সেজেস্টো লিঃ, সহজ লিঃ, উবার বাংলাদেশ লিঃ, বাডি লিঃ, আকিজ অনলাইন লিমিটেড।
ধারাবাহিক এ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাচাইবাছাই শেষে বৈধতা দেয়ার কথা জানিয়ে বিআরটিএ সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক পরিচালক মাহবুব-ই রব্বানি বলেছেন, রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে এতদিন নানা অভিযোগ থাকলেও বিআরটিএ কোন ব্যবস্থা নিতে পারছিল না। এখন নীতিমালার অধীনে সব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে।
পাশাপাশি পুরো প্রক্রিয়াকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার মাধ্যমে সরকারও রাজস্ব আদায় করতে পারবে। নিবন্ধনের পর রাইড শেয়ারিং এ্যাপগুলো আগের নিয়মেই পরিচালিত হবে। রাইড ডাকা বা রাইডে চলাচলের পদ্ধতিতে কোন পরিবর্তন হবে না। তবে নীতিমালার আওতায় গ্রাহক সেবার মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা অনেকাংশে নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করেছে বিআরটিএ।
যদি কোন রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান একবার নিবন্ধন পায় তাহলে তাদের প্রতিটি নীতিমালা মেনে চলতে হবে বলে জানিয়েছেন রব্বানি। তিনি বলেন, যদি কোন প্রতিষ্ঠান নীতিমালার শর্ত ভাঙ্গে প্রাথমিকভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া হবে। পাশাপাশি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করাসহ প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।