রবিবার ● ৫ মে ২০১৯
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » প্রাকৃতিক দুর্যোগে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাবহার
প্রাকৃতিক দুর্যোগে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাবহার
বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর ক্ষতি মোকাবেলায় যেসব প্রযুক্তি-উদ্যোগ নেয়া হয় বিজ্ঞান উৎকর্ষের কল্যাণে সেসবের জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে বন্যা ও সাইক্লোনের পূর্বাভাসে এক সময় প্রচুর অসঙ্গতি ছিল। যার কারণে মানুষের কাছে এসব পূর্বাভাসের কোন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু গত প্রায় দুই দশক ধরে তথ্য-প্রযুক্তির গবেষণায় এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা গেছে। সরকারী পূর্বাভাসের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে অনেক, সচেতনতাও বেড়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের তুলনায় এখন অনেক কম, বিশেষ করে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক সীমিত হয়ে এসেছে।
জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার সংজ্ঞায়নে একটি ব্যবস্থাকে আলাদা করে রেখেছেন তা হলো ‘জরুরী টেলিযোগাযোগ’। আমরা অনেকেই ৯৯৯-এর কথা জানি। জরুরী প্রয়োজনে, বিশেষ করে পুলিশী সহায়তা, মেডিক্যাল সাহায্য ও আগুন নেভানোর কাজে নির্বাপক দল ডাকতে এই নাম্বারে কল করা হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশেও এই সুবিধাটি চালু করা হয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে এলার্ট ব্যবস্থা চালু আছে অনেক দেশে, সাধারণত গণমাধ্যম ব্যবহার করে (প্রধানত রেডিও-টেলিভিশন) এই এলার্ট প্রচার করা হয়। আজকাল অনেক মোবাইল উৎপাদক কোম্পানি ও অপারেটর এরকম এলার্ট ব্যবস্থা চালু করেছে। আপনি যে এলাকায় অবস্থান করছেন আপনার ফোন সে অবস্থান শনাক্ত করে ওই নির্ধারিত অঞ্চলের বৃষ্টি, বন্যা বা ঝড়ের পূর্বাভাস আগাম আপনাকে একটি এলার্ট মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দেবে। আই-ফোনের এই ব্যবস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রে খুবই জনপ্রিয়, বিশেষ করে বৃষ্টি ও তুষারপাতের পূর্বাভাস জনসাধারণের জানা বিশেষ জরুরী বলে এই ব্যবস্থা সেখানে চালু আছে। বিশ্বের আরও অনেক দেশে এই জরুরী ব্যবস্থা চালু আছে, কোথাও সরকারী উদ্যোগে, কোথাওবা বেসরকারী উদ্যোগে।
বিপদে পড়ে সাহায্য চাওয়ার এই ৯৯৯ ব্যবস্থা প্রথমে চালু হয় লন্ডনে ১৯৩৭ সালে। প্রথম কিছুদিন অল্প কিছু এলাকায় এই সুবিধা থাকলেও ধীরে ধীরে সমগ্র ব্রিটেনে এই সুবিধা সম্প্রসারিত হয়। এতে সময় লেগেছিল প্রায় ৪০ বছর। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বাংলাদেশে যখন এই জরুরী ব্যবস্থা চালু হয়, সমগ্র দেশে তা চালু করতে মাত্র মাস কয়েক সময় লেগেছিল। এখন সে সুবিধা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত ৯৯৯ কল একটি কল সেন্টারের মাধ্যমে যথাযথ স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। আপনার ফোনের লোকেশন বা আপনি যে ফোন থেকে সাহায্য চেয়েছেন তার ভৌগোলিক অবস্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ৯৯৯ কল সেন্টারে পৌঁছে যায়। ফলে জরুরী সেবা পৌঁছাতে সময় যেমন কম লাগে, তেমনি কোন বিশেষ এলাকার সংশ্লিষ্ট আপদ সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে প্রয়োজনীয় তথ্যসেবা দেয়াও সহজতর হয়। জরুরী প্রয়োজনে বাংলাদেশে ৯৯৯ কল ব্যবস্থা এখন খুবই জনপ্রিয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এমন জরুরী সেবা ব্যবস্থা চালু আছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসে জরুরী টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অনেকটাই এখন দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেট ও নিউ মিডিয়া। আমরা ইন্টারনেটভিত্তিক যেসব সংবাদ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি সেখানে আবহাওয়া তথ্য বা আবহাওয়া জেনে কোন কাজে হাত দেয়া একটি জরুরী বিষয়। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় (মুখ্যত ফেসবুক, টুইটার) অনেকে স্থানীয় তথ্য দিয়ে থাকেন; কিন্তু নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকায় এসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতাও কম। কিছু সরকারী দফতরের ও বিশিষ্টজনের সামাজিক যোগাযোগে ভেরিফায়েড পেজ আছে। সেগুলোর দেয়া তথ্য কোন কোন ক্ষেত্রে জরুরী সেবায় গ্রহণযোগ্যতা পায়। যদিও আমাদের দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকেরই তাদের ভেরিফায়েড পেজে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যেখানে একটা সেবাধর্মী পোস্ট দিতে দেখা যায় না, সেখানে বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ লিখতে এরা একটু বেশিই ব্যস্ত থাকেন।
ফলে নিউ মিডিয়ার সর্বগ্রাসী বিস্তারের ঘনঘটায় আমাদের দেশের সেবা সুবিধায় এর ব্যবহার অনেকটাই সঙ্কুচিত; হয়ত আমরা এর গুরুত্ব এখনও ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে একমাত্র ব্যতিক্রম কমিউনিটি রেডিও। গত প্রায় এক দশক ধরে কমিউনিটি রেডিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সরকারী বার্তা প্রচার করে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট ১৮টি কমিউনিটি রেডিও চালু হয়েছে ও সম্প্রচার কাজে নিয়োজিত আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুক্রমে সারাদেশে কমিউনিটি রেডিও চালুর বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত হলে আমাদের দেশের বার্তা প্রচারে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের একটি বৈপ্লবিক রূপান্তর দৃশ্যমান হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ছাড়াও দেশের উন্নয়ন কাজের সঠিক বার্তাবাহক হিসেবেও এই মাধ্যমটিকে কাজে লাগাবার বাস্তব যুক্তি রয়েছে।
দৃশ্যত, আমাদের নির্ভর করতে হয় সরকারী গণমাধ্যম ও দফতরগুলোর তথ্যের ওপর। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল, থেকে চালু থাকা রক্ষণশীল গণমাধ্যম সম্প্রচার জনগণের আস্থা হারিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে এমনকি দেশের সামরিক শাসনামলেও দেখা গেছে প্রকৃত তথ্য প্রচারে একটি সঙ্কীর্ণ নীতি অনুসরণ করা হতো। সুখের বিষয় ডিজিটাল বাংলাদেশে সঙ্গত কারণেই সরকারী প্রচারে কোন লুকোছাপা নেই। যে কারণে এখন সরকারী তথ্যের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে অনেক বেশি। দেখা যাচ্ছে ইন্টারনেটে সকল তথ্য পাওয়া গেলেও আমাদের দেশের মানুষ এখন সরকার কি বলছে বা সরকারী দফতরের ভাষ্য কি তা নিয়ে ভাবছে বেশি; গণমাধ্যমও সরকারী ভাষ্যের প্রচার করছে বেশি। এই আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার ফলে একদিকে যেমন সরকারের তথ্যে জনগণের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তেমনি দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমে এসেছে অনেক বেশি।
ফলে আমাদের গুরুত্ব দেয়া দরকার তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্যোগে নিরাপদ থাকার উপযোগী তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতি মনোযোগী হওয়া। বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলে জনগণের জন্য সঠিক, মানসম্পন্ন ও প্রত্যক্ষ তথ্য প্রচার বেশি জরুরী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আইটিইউ (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) যে ৪টি আন্তঃকেন্দ্রিক বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলছে (প্রস্তুতি, সাড়া দেয়া, মোকাবেলা ও কাটিয়ে ওঠা) তার প্রতিটি ধাপের মধ্যে এই মানসম্পন্ন বার্তা সম্প্রচার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের ভুলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কিছু কারণ সংঘটিত হচ্ছে। আমরা যেগুলো পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মিলিয়ে সেসব ভুলের সংশোধন করে নেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছু ভুল আমরা ইতোমধ্যে করে ফেলেছি, যা আর শোধরাবার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রতিকার আছে- যেন একই ভুল আমরা আর না করি। ভুলের মাত্রা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি দুনিয়াজুড়ে এখন বিতর্ক চলছে পরিবেশের বিপর্যয়ে কে বেশি দায়ী ও কে বেশি দায় নেবে এবং খেসারত দেবে। অবশ্যই উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এসবের দায় মাথায় নিয়েছে; কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সেসব বিষয়ে সতর্ক থাকার সুযোগ আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম সুবিধা হলো এর রয়েছে নিজস্ব যোগাযোগ স্যাটেলাইট, যা গুছিয়ে নিলে প্রকৃতির প্রায় সব ধরনের রূপান্তর, পরিবর্তনের তথ্য দিতে সক্ষম। আমাদের আবহাওয়া দফতর, মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও গণমাধ্যম কর্মীদের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকা দরকার যাতে আমরা বিজ্ঞানের প্রাপ্ত সব সুবিধা নিয়ে দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে প্রস্তুত থাকতে পারি।
তথ্য-প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের হাতে এখন মোবাইল ফোন আছে। ঘরে ঘরে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রাপ্তি সহজতর হয়েছে। আমাদের রেডিও-টেলিভিশন সম্প্রচার এখন ইন্টারনেটনির্ভর হতে চলেছে। বর্তমান সরকার দেশে ইন্টারনেট টিভি (আই পি টিভি) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। গত এক দশকে একটি প্রজন্ম ডিজিটাল বাংলাদেশের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব শিক্ষা নিয়ে ও দৃশ্যমান বাস্তবতা দেখে দেখে বড় হচ্ছে। সর্বোপরি, এসব কাজে সরকারের প্রণোদনা ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি আছে, যা বিশ্বের প্রযুক্তিসেবার উন্নয়ন ইতিহাসে বিরল। এত সব সুবিধা অর্জন করে নিশ্চয়ই আমরা সঠিক তথ্য দেশের মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সক্ষম বলে দাবি করতে পারি। সামনের দিনগুলোতে আমাদের শুধু তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দেয়ার বাকি।