বুধবার ● ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
প্রথম পাতা » আইসিটি সংবাদ » বাংলাদেশে আসছে আইপিভি-৬
বাংলাদেশে আসছে আইপিভি-৬
ইন্টারনেট ব্যবহারের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ‘আইপিভি-৬’-এ যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে ডিভাইসের অবস্থান শনাক্ত সহজ হবে। বন্ধ হবে ‘স্পুফিং’ ও ‘মাস্কিং’সহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধ।
আইপিভি-৬ কী?
ইন্টারনেটের সংযুক্ত থাকা ডিভাইসগুলোর ইন্টারনেটভিত্তিক ঠিকানা থাকে। যেটিকে আইপি ঠিকানা বলা হয়। এই ঠিকানা দিয়ে ইন্টারনেট বিশ্বে সংযুক্ত থাকা একটি ডিভাইস শনাক্ত এবং সেটি কোথায় আছে তা বের করা যায়। এ আইপি ঠিকানার দুটি সংস্করণের একটি ‘ইন্টারনেট প্রটোকল ভার্সন-৬’ বা ‘আইপিভি-৬’।
কিভাবে ও কখন এলো?
আইপিভি-৬ সংস্করণের আগে প্রথম এসেছে ‘আইপিভি-৪’ সংস্করণ। ১৯৮৩ সালে এই আইপিভি-৪-এর জন্ম। এরপর ১৯৯০-এর দিকে বিশ্বে দ্রুত ইন্টারনেট সম্প্রসারণের পর ভাবনায় আসে আইপিভি-৪-এর যে ‘নির্দিষ্ট ঠিকানা’ তা দিয়ে বিশ্বের সব সংযুক্ত ডিভাইসের মৌলিক ঠিকানা দেওয়া সম্ভব হবে না। সেই সময় থেকে ১৯৯২ সালে আসতেই দেখা যায় আইপিভি-৪-এর মোট ঠিকানার ৬০ শতাংশ দেওয়া হয়ে গেছে। এর সক্ষমতা ছিল ৪৩০ কোটি ঠিকানা। তখন দুটি পরিকল্পনা নেয় ‘ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইন নেইমস অ্যান্ড নাম্বারস’ বা ‘আইক্যান’। একটি হলো, আইপি ঠিকানা যেন আর অপচয় না হয়। আইপিভি-৪-এ যেগুলো আছে তা পরিকল্পনা অনুযায়ী বিতরণ করা। আরেকটি হলো নতুন আইপি সংস্করণ তৈরির পরিকল্পনা।
এসবের জন্য আইক্যান গঠন করল ‘ইন্টারনেট অ্যাসাইন্ড নম্বর অথরিটি’ (আইএএনএ)। কাজ শুরু করে ইন্টারনেট ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্কফোর্স।
১৯৯৭-১৯৯৮ সালে নতুন সংস্করণের খসড়া আদর্শ ঠিক হলো এবং আইবিএম প্রথম তাদের এআইএক্স ৪.৩ অপারেটিং সিস্টেমে আইপিভি-৬ ব্যবহার করে।
তত দিনে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়ার মতো আইপিভি-৪ শেষ। এরপর ২০১২ সালে ছাড়া হলো আইপিভি-৬। যদিও এর চূড়ান্ত সংস্করণ আসে ২০১৭ সালে। এতে ঠিকানা ফুরানোর ভয় নেই। কারণ এখানে ৩৪০ ট্রিলিয়নের বেশি ঠিকানা রয়েছে।
আইপিভি-৬ এর সাধারণ প্রকৌশল
আইপিভি-৬ হলো ১২৮ বিটের ঠিকানা পদ্ধতি। এ ঠিকানা দেখা যায় চারটি হেক্সাডেসিমেল সংখ্যার আট গ্রুপে। এতে প্রতিটি গ্রুপ আলাদা হয় কোলন চিহ্ন দিয়ে।
যেমন-2001:0db8:85a3:0000:0000:8a2e:0370:7334।
আইপিভি-৬ এর সুবিধা কী?
প্রথম সুবিধা বিশ্বে যত ডিভাইস রয়েছে প্রতিটির একটি করে আসল ইন্টারনেট ঠিকানা দেওয়া সম্ভব। আইপিভি-৪-এ সেটা সম্ভব নয়। ধরা যাক দেশের একটি মোবাইল অপারেটরের কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সবাইকে কি আসল আইপি ঠিকানা দেওয়া গেছে? উত্তর হলো, না।
আসলে এ সংখ্যা হয়তো লাখখানেক বা এর চেয়ে একটু বেশি মূল বা আসল আইপি ঠিকানা রয়েছে। এ আসল ঠিকানার একেকটির পেছনে দেখা গেল অসংখ্য ঠিকানার জাল তৈরি করা হয়েছে।
বিষয়টি প্রতিটি মোবাইল ফোন অপারেটর এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এখন আসল ঠিকানার বিপরীতে যে অসংখ্য ঠিকানা দেওয়া হলো, তাদের কিন্তু কোনো আইডেন্টি বা স্বীকৃতি নেই। সেখানে আরো অসুবিধা হলো, এগুলোর ব্যবহারকারীকে কোনো প্রয়োজনে চিহ্নিত করা যায় না এবং অপারেটরগুলোকে এই নেট তৈরিতে বাড়তি খরচও করতে হয়। আইপিভি-৬-এ এসব কোনো সমস্যা নেই।
আইপিভি-৪-এর নেটওয়ার্কে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। সেখানে অনেক সেবা ক্ষেত্রবিশেষে চালানো যায় না। একটি আসল ঠিকানার বিপরীতে যখন অসংখ্য ব্যবহারকারী হয়ে যায় এবং তারা যদি অনেক সেবা নিতে চায়, সে ক্ষেত্রে একপর্যায়ে দেখা যায় কিছু কিছু সার্ভিস চলছে না। এটাই স্বাভাবিক।
আইপিভি-৬-এ এই সমস্যা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি পরীক্ষিত যে আইপিভি-৪-এর চেয়ে উন্নত ডিজাইন ও সংগঠিত প্রযুক্তি আইপিভি-৬। তাই কারিগরি দিক থেকেও আইপিভি-৬-এর কার্যক্ষমতা ভালো। ইন্টারনেটে ভিডিও বা অডিও স্ট্রিমিং, ইন্টারেক্টিভ গেইম, আইপি টেলিফোন ও ই-কমার্সের মতো ওয়েব সেবা ও অনলাইন অ্যাপে আইপিভি-৬-এর সেবা পাওয়া যায় স্বাচ্ছন্দ্যে। এ ছাড়া ফেইসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিজেদের ব্যবহারকারীদের ওপর জরিপ করে দেখেছে এ নেটওয়ার্কে বিলম্ব কম হয়। এটা বেশ উন্নত। এ ছাড়া এ নেটওয়ার্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কনফিগারেশন হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ পদ্ধতি চালু হলে অন্যান্য সুবিধার পাশাপাশি প্রতিটি ডিভাইসের অবস্থান শনাক্ত হওয়ায় ‘স্পুফিং’ ও ‘মাস্কিং’ পদ্ধতিতে সংঘটিত অপরাধসহ সব সাইবার অপরাধ কমে আসবে।
কী করছে সরকার?
বাংলাদেশ এখনো আইপিভি-৪ অ্যাড্রেসিং পদ্ধতি ব্যবহার করছে। অথচ অনেক দেশেরই আইপিভি-৪ ঠিকানা ফুরিয়েছে। কোনো কোনো দেশ পুরোপুরি আইপিভি-৬ ব্যবহার করছে। আবার অনেক দেশে আইপিভি-৬ সবার কাছে না যাওয়ায় আইপিভি-৪ পদ্ধতিও একই সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের এই সর্বাধুনিক ইন্টারনেট প্রটোকল বা আইপি অ্যাড্রেসিং পদ্ধতি আইপিভি-৬-এ যুক্ত হতে এবার বেশ ভালোভাবেই উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
নতুন আইপি অ্যাড্রেসিং পদ্ধতিতে যেতে এরই মধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গঠন করেছে একটি স্টাডি গ্রুপ।
স্টাডি গ্রুপ ডিসেম্বর মাসে দুটি বৈঠকও করেছে। এতে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, ইন্টারনেট গেটওয়ে ও মোবাইল ফোন অপারেটররা অংশ নিয়েছেন।
বৈঠকগুলোতে আইপিভি-৬ গ্রহণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্বগুলো নিয়ে মূলত আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাই আইপিভি-৬ গ্রহণের সম্ভাব্য সমস্যা, চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা এবং সমাধানের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সবার পক্ষ থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, বাংলাদেশ সর্বাধুনিক সংস্করণের তথ্য-প্রযুক্তি গ্রহণে পিছিয়ে থাকবে না। বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে সরকার।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
বিডিনগ বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান এবং জাতিসংঘের ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামে (আইজিএফ) মাল্টি স্টেকহোল্ডার অ্যাডভাইজারি গ্রুপের সদস্য সুমন আহমেদ সাবির আইপিভি-৬ বাস্তবায়ন কার্যক্রমের পরামর্শক। তিনি জানান, চাইলে ছয় মাসের মধ্যে দেশে আইপিভি-৬ চালু করা সম্ভব। চ্যালেঞ্জও যে খুব বেশি তাও নয়। অপারেটরগুলো অ্যাপনিকের কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়েই তা চালু করতে পারে। যেসব কারিগরি বিষয় রয়েছে, সেগুলো ঠিকঠাক করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
ইন্টারনেট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সাবির আরো জানান, আইপিভি-৬ চালু হলেও আইপিভি-৪ বন্ধ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। দেশের সব নেটওয়ার্ক যখন আইপিভি-৬-এর আওতায় আসবে তখনই শুধু আইপিভি-৪ বাদ দেওয়া যাবে। এ ছাড়া দেশের ইন্টারনেট গেটওয়ে অপারেটরগুলোও আইপিভি-৬ প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য কারিগরিভাবে তৈরি আছে। তথ্যসূত্র - কালের কণ্ঠ