বুধবার ● ২ অক্টোবর ২০১৩
প্রথম পাতা » নিউজ আপডেট » কালো টাকার ৬০% বৈধ ব্যবসা থেকে!
কালো টাকার ৬০% বৈধ ব্যবসা থেকে!
খান এ মামুন
৷৷খান এ মামুন ৷৷ ধীরগতিতে হলেও জাতীয় আয় মোটামুটি সামনের দিকেই এগোচ্ছে। নতুন নতুন স্কুল-কলেজ তৈরি হচ্ছে। বহু কলকারখানাও গড়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন দুই রূপ। একদিকে সুদৃশ্য বিলাসবহুল বাড়ি, দামি গাড়ি। অন্যদিকে শ্রমশক্তিসম্পন্ন মানুষের অর্ধেকই নিরক্ষর। জমি ও জলবায়ু উত্কৃষ্ট হলেও জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবে উৎপাদন বিশ্বের নিচের সারিতে। দেশী ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, কালো অর্থনীতি বাংলাদেশের পাপ, উন্নয়নের অন্যতম সংকট।
কালো অর্থ নিয়ে গবেষণাকারী বিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। সম্প্রতি তারা হিসাব করে দেখেছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৭ শতাংশ কালো টাকা। আর এর বড় অংশ অর্থাত্ ৬০ শতাংশের উত্পত্তি বৈধ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকে এসব অর্থ উপার্জন হলেও কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া হচ্ছে না তার সঠিক হিসাব। জমি-বাড়ি কেনাবেচা, শিল্প উৎপাদন, পেশাগত কাজ, নির্মাণ-সংক্রান্ত কাজ, পাইকারি ব্যবসা, কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দেয়া এবং তা থেকে কমিশন ও সরকারি কেনাকাটায় অর্থ আত্মসাত্ থেকে তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি কালো টাকা। জিএফআই বলছে, বাংলাদেশে বর্তমান অর্থনীতির আকারকে বিবেচনায় নিলে তা প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ হতে পারে; যা মূলধারার মতো সমান্তরালভাবে অর্থনীতিতে তৈরি হচ্ছে।
প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কালো টাকার সঙ্গে জড়িতরা ক্ষমতাবান। এ কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। তাদের শাস্তির আওতায় আনলে দেশে কালো টাকার পরিমাণ কমে আসবে। পাশাপাশি সব ধরনের লেনদেনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলেও কমে আসবে কালো টাকার পরিমাণ।
তিনি বলেন, দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন রয়েছে। আইনটি সংশোধন করে যুগোপযোগীও করা হয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় কালো টাকার প্রবাহ কমানো যাচ্ছে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, কালো টাকাকে মূলধারায় আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও পর্যাপ্ত সক্ষমতা তাদের নেই। তাই এককভাবে একটি সংস্থা বা সংগঠনের পক্ষে কালো অর্থনীতিকে কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা ফাঁকি রোধে এনবিআর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক তত্পর। যদিও বারবার সুযোগ দেয়ার পরও ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশে কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৯৮ কোটি টাকা।
এনবিআরের কর বিভাগের সিনিয়র সদস্য মো. বশির উদ্দিন বলেন, ‘কালো টাকার পরিমাণের তথ্যে ভিন্নতা আছে। বিশ্বের বড় দেশগুলোতেও কালো টাকার অস্তিত্ব রয়েছে। আমাদের দেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তবে কালো টাকা কমিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এনবিআর।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। জিএফআইয়ের হিসাবে, এর ৩৭ শতাংশ অর্থাত্ ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫ কোটি টাকা কালো। এ অর্থের প্রায় ৬০ শতাংশ সৃষ্টি হচ্ছে বৈধ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করছে, তার একটি বড় অংশ সরকারের সংস্থাগুলোর কাছে প্রকাশ করছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম দেখানো হচ্ছে। আবার ব্যয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে গরমিল। ব্যয় বেশি দেখিয়ে বছরের পর বছর লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনবিআরের কাছে আয়কর বিবরণী জমা দেয়া হয়। বিশেষ করে বড় করপোরেটদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা অনেক বেশি বলে জানান বৃহত্ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আবার সরকারি ক্রয়ক্ষেত্রেও বড় অঙ্কের দুর্নীতি হয়। এর মধ্যে রয়েছে, প্রকল্পের ব্যয় বেশি দেখিয়ে অনুমোদন করে বড় অঙ্কের অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়া। গত এক দশকে বিদ্যুত্, পানিসম্পদ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনেক প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রামাণিক বহু তথ্য পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
সংস্থাটি সম্প্রতি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ১৭টি প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়টি চিহ্নিত করেছে। প্রাথমিক হিসাবে, প্রকল্পগুলোর বিপরীতে তারা ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা অস্বাভাবিক ব্যয় পেয়েছে। বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে এর জবাব চেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পদ্মা সেতু ২০০৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করলেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এখনো এর নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারি ক্রয়ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রতিযোগিতা না থাকায় দুর্নীতির সুযোগগুলো সৃষ্টি হয়েছে। এতে সরকারি ক্রয়ক্ষেত্র থেকে কালো টাকার উত্পত্তি হচ্ছে। দেশে এসব কালো টাকা যে বিদ্যমান, তা সরকারের নীতির মধ্যেই স্বীকৃত।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) কার্যক্রমের মাধ্যমে কালো টাকা উৎপাদন হচ্ছে। আবাসন ব্যবসা থেকেও এর একটি বড় অংশ উত্পত্তি হয়। বিশেষ করে রেজিস্ট্রি করার সময় প্লট ও ফ্ল্যাটের দাম কম দেখানো হয়।
জিএফআইয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে কালো টাকার ৩০ শতাংশের উত্স অপরাধমূলক কার্যক্রম। বর্তমান জিডিপির হিসাবে এর মধ্যে রয়েছে- পণ্য চোরাচালান, অবৈধভাবে বনজ সম্পদ দখল, মাদক ব্যবসা, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, জাল টাকা, নকল দলিল ও আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। অর্থনীতিতে এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে কালো টাকার পরিমাণ বর্তমান জিডিপির হিসাবে ১ লাখ ১৫ হাজার ২১৬ কোটি টাকা।
তবে জিএফআইয়ের হিসাব ও বিশ্লেষণের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ৬০ শতাংশ কালো টাকা বৈধ ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে আসে, এটি কিছুটা অতিরঞ্জিত। এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ হতে পারে। কারণ ব্যবসায়ীরা যা করেন, তাদের একটি হিসাবের মধ্যে করতে হয়। কিন্তু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কোনো হিসাবের বালাই নেই। ফলে কালো টাকার সবচেয়ে বড় অংশ আসে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সরকারি সম্পদ অবৈধভাবে দখল ও বিক্রি এবং ঘুষ ও চোরাচালান থেকে সিংহভাগ কালো টাকা আসে।
অর্থ পাচার করে বিদেশে প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করার অভিযোগ উঠছে। বাংলাদেশী ২০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের মহাপরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের নথি সূত্রে জানা গেছে, দেশের বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিতে অফশোর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব ব্যবসা চালিয়ে আসছে।