সোমবার ● ১৪ নভেম্বর ২০১১
প্রথম পাতা » খোলা কলম » মোবাইল ফোনের টাওয়ার পরিবেশের জন্য কতটুকু নিরাপদ
মোবাইল ফোনের টাওয়ার পরিবেশের জন্য কতটুকু নিরাপদ
ড. আহমেদ ইমতিয়াজ:
প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষকে আরাম-আয়েশ ও উন্নত জীবনের নিশ্চয়তাসহ স্বপ্নময়ী করে তুললেও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং তার প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই জীবনকে বিভীষিকাময় এবং অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে দাঁড় করায়। পারমাণবিক বোমার ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ইত্যাদি বিশ্ববাসীর জন্য প্রযুক্তির এক ধরনের অভিশাপ। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মোবাইল অ্যান্টেনা বা টাওয়ার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ৪০ তলা ভবন বা তদূর্ধ্ব কোন উঁচু স্থানে অ্যান্টেনা বসানোর নিয়ম। মাত্র শূন্যটা বাদ দিয়ে ৪ তলায় বসালেও আমাদের পা-িত্ব অক্ষুণ্ন থাকত। কিন্তু একেবারে বর্গমূল গিয়ে হাজির। টাওয়ার বসাতে ২ তলা ভবনই বেশি পছন্দ। কোন রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চরম অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে আবাসিক ভবন, মার্কেট, স্কুল ও কলেজের বিল্ডিংয়ে টাওয়ার বসাতে দেখা গেছে। এমনকি হাসপাতালের ওপরও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ভবনের প্রধান প্রকৌশলী মালিক নিজেই। গ্রামের মিস্তি তার যোগ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট। গাছতলায় বসে কাঠি দিয়ে মাটিতে নকশা এঁকে গড়েছেন প্রাণঘাতী ইমারত। এদের নকশা করার নিপুণতা দেখলে ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের দুর্বলই মনে হয়! ভবনগুলো নিজেই নিজের ভার বহন করার ক্ষমতা রাখে না। তদুপরি টাওয়ারের বাড়তি বোঝা! এমনকি একই ভবনের ওপর ৪-৫টি টাওয়ারও চোখে পড়ে। কিন্তু পরিবেশ তথা মানুষ, জীব-জন্তু ও উদ্ভিদকুলের ওপর মোবাইল টাওয়ারের আদৌ কোন ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না, সে বিষয়ে কোন গবেষণা লব্ধ তথ্য-উপাত্ত আজও চোখে পড়েনি। পরিবেশের ওপর ওসব টাওয়ারের সত্যিকার যদি কোন ক্ষতিকর প্রভাব থাকে তবে পরের প্রজন্মকে যুগযুগ ধরে তার মাসুল দিতে হবে।
যেসব কারণে টাওয়ার ক্ষতিকর হতে পারে তাহলো_
(ক) সাধারণত যে কোন ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড (ইএমএফ), ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (ইএমআর) এবং রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি (আরএফ) স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। উল্লেখ্য, মোবাইল টাওয়ার থেকেও এক ধরনের আরএফ, ইএমএফ ও ইএমআর তৈরি হয়। যদিও বলা হচ্ছে, টাওয়ারের কারণে যে আরএফ, ইএমএফ বা ইএমআর হয় তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু মোবাইল ও টাওয়ারের যে সংখ্যা ও ঘনত্ব তাতে বিষয়টি আর মোটেও নিরাপদ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, এককভাবে একটি টাওয়ারের যে আরএফ, ইএমএফ এবং ইএমআর তা ক্ষতিকর না হলেও একই ভবনে বা এলাকায় অনেক টাওয়ার বসানোর ফলে রিং অ্যাঙ্গেলের ওসিলেটিং বা বিকিরণের ওয়েভ বেড়ে যায় এবং সামগ্রিকভাবে যে আরএফ, ইএমএফ এবং ইএমআর তৈরি হয় তার মাত্রা অনেক, ফলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
(খ) মোবাইল টাওয়ারের কাছে বসবাসকারী মানুষদের যেহেতু এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ মোকাবেলা করে চলতে হয়, তাই তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির পরিমাণ খুবই বেশি। কারণ, মোবাইল টাওয়ার হতে প্রতি বর্গমিটারে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা হচ্ছে ১৭১০০ থেকে ৭২০০০ মাইক্রোওয়াট এবং ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফ্রিকুয়েন্সি হলো ১৯০০ মেগাহার্জ; যা ভবনে বা আশপাশে বসবাসকারীদের শরীরে সহজেই ভেদ করতে পারে। এটা মানুষের শরীরে মুক্ত বা সুপার আয়ন তৈরি হওয়ার কারণসহ ক্যান্সার, হৃদরোগ, ব্রেন টিউমার এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্গান ড্যামেজের সম্ভাবনা দারুণভাবে বাড়িয়ে দেয়। ফলে টাওয়ারের কারণে মানুষেরতো বটেই বরং এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী যে কোন জীবেরগুলোর ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি জেনেটিক পরিবর্তনসহ মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট, অবসন্নতা, লিউকেমিয়া, এলার্জি, মাথাব্যথা এবং চর্মরোগও হতে পারে। উল্লেখ্য, পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা থাকে। শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশও ব্যাহত হতে পারে। এসব রোগ উপসর্গ ১০-২০ বছর পরে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রমাণিত না হলেও পরিবেশ তথা পশু-পাখি গাছপালার ওপর টাওয়ারের কতকগুলো ক্ষতিকর প্রভাবের কথা ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, যেমন_
(১) বাদুড় ও পশু-পাখির ওপর প্রভাব : আমরা অনেকেই জানি বাদুড় দিক নির্ণয়ের জন্য এক ধরনের শব্দ তরঙ্গ বা সেন্সর ব্যবহার করে যার দ্বারা নিজেকে গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা অনুরূপ কোন উঁচু জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা লাগা থেকে রক্ষা করে। অর্থাৎ সরকারি জমি দখলের মাধ্যমে রাস্তার সীমানার মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নিয়মনীতি অমান্য করে ত্রুটিপূর্ণ নকশায় দুর্বলভাবে সামনে কোন ভবন নির্মিত হয়েছে কি না, বাদুড় বেশ দূর থেকেই তা টের পেয়ে ধাক্কা লাগার আগেই গতিপথ পরিবর্তন করে। কিন্তু মোবাইল টাওয়ার বাদুড়ের এই তীক্ষ্ন সেন্সরকে জয় করে প্রাণীটিকে ধোকায় ফেলেছে। উড়াল দেয়ার পরেই বাদুড়ের মনে হয় পথজুড়ে নিরেট কী যেন গতি রোধ করে আছে। তাইতো বাদুড় মোবাইল টাওয়ার এলাকায় না এসে চলার পথ পরিবর্তন করে, না হয় অনেক ওপর দিয়ে চলাফেরা করতে বাধ্য হয়। শুধু বাদুড় নয় বরং অন্য পাখিও টাওয়ারকে কাক তাড়ুয়ার মতো মনে করে, ভয় পায় এবং অস্বস্তিবোধ করে। ফলে টাওয়ার এলাকায় প্রতিদিন বাদুড় ও পাখির সংখ্যা কমছে।
(২) প্রজাপতি-মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস : স্যাটল ম্যারেজে যুবক-যুবতীর সন্ধিতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ঘটক প্রয়োজন হয়। প্রচলনটি ঐতিহ্যবাহী। লাভ ম্যারেজ আধুনিক। এই লাভের ছদ্মবেশেই বাটারফ্লাই পুরুষরা জায়গা মতো হাজিরা দেয়। আধুনিকতার আবেশে বাটারফ্লাই স্বভাবের মধুময়ী নারীর প্রতুলতাও সমাজে কম নয়। প্রজাপতি-মৌমাছিরা ফুলে ফুলে ঘুরে মধু-পরাগ খেয়ে গেলেও পুরুষ ও স্ত্রী ফুলের মধ্যে পরাগায়ন ঘটিয়ে ন্যাচারাল ঘটকের কাজটি করে থাকে। এই প্রাকৃতিক ঘটকটি ছাড়া পতঙ্গপরাগী ফুল থেকে ফল পাওয়া অসম্ভব। একদিকে মোবাইল টাওয়ারের টালমাটাল অবস্থা অন্যদিকে কীটনাশক প্রয়োগের নাশকতা। ফলে প্রজাপতি-মৌমাছি, কীট-পতঙ্গরা উধাও। বিভিন্ন তথ্যমতে, ৭০-৮০ ভাগ মৌচাক কমে গেছে। ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হবেই। প্রাকৃতিক বুনন নষ্ট করে পরিবেশ নিয়ে হায় হুতাশ করে লাভ নেই।
(৩) ডাব, কলা ও আমের ওপর প্রভাব : রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি, সে শাঁসের মেয়াদ’। সদ্য সাবালিকাদের কুমারিত্বকে রবীন্দ্রনাথ কচি ডাবের মতোই ভেবেছেন হয়তো! কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকাল তেলতেলে মসৃণ সবুজেভরা কচি ডাব আর পাওয়া যায় না বললেই চলে। সব গা ফাটা, অমসৃণ পানি শূন্য ডাব। আত্মাহীন গা ও পা ফাটা মানুষের যে দশা অধিকাংশ ডাবের অবস্থাও তাই। ফলে কচি ডাব আর ঝুনো ডাবের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিনই বটে। ডাব পায়ীদের জন্য এটা বড়ই দুঃসংবাদ। কারণ, গাঢ় সবুজেভরা মসৃণ কচি ঠা-া ত্বকের ডাব দু’হাতে ধরে ঢক ঢক করে পান করার মজাই আলাদা। গ্লাসে ঢেলে বা নলে পান করলে ওই তৃপ্তি আসে না। কিন্তু ডাবের এ অবস্থা কেন? ডাবচাষি, ক্রেতা, বিক্রেতাসহ সবার একই জবাব ‘মোবাইল টাওয়ার’। মোবাইল টাওয়ারের কারণে ডাব তার কচিত্ব কুমারিত্ব হারাচ্ছে। শুধু ডাব নয়, কলা ও আমের অবস্থাও একই। বিভিন্ন ফলমূল তাদের আকর্ষণীয় লাবণ্য ও বাহ্যিক সৌন্দর্য খুইয়েছে। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে টাওয়ার এলাকায় গাছে ফুল ও ফল কম এসেছে এবং ফলের দাগ ও পতন বেড়েছে। কিন্তু আসলেই কি মোবাইল টাওয়ারের কারণে এসব ঘটছে? হয়তো হ্যাঁ! হয়তো না! বর্তমানের সব ছাত্রছাত্রী ডাক্তার হতে চায়, অভিভাবকদের আশাও তাই, বর ও কনে পক্ষ একই চাওয়ায় আপসহীন। মোবাইল টাওয়ারের কোন ক্ষতিকর প্রভাব থাকলে নিকট অতীতে সবাই ডারমাটোলস্টিস হতে চাইবে বলেই ধারণা। অবশ্য তাতে আর যাই হোক ফেয়ারনেস ক্রিম বিক্রেতা এবং বিউটি পারলার মালিকদের ব্যবসা কিন্তু কম হবে না।
(৪) টাওয়ারের টেকনিশিয়ানদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি : কয়েক টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দীর্ঘ সময় টাওয়ারের ইঞ্জিন কক্ষে কাজ করলে তাদের অস্বস্তিবোধ হয় এবং শরীর খারাপ করে। মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়। তাই দুই আড়াই ঘণ্টা পর পর রিফ্রেশ হওয়ার জন্য তাদের ইঞ্জিন কক্ষের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।
গত ১ জুন, ২০১১ তারিখে ইউএসএ টুডের ১ম পাতায় প্রধান খবরটি ছিল ‘সেলফোন ও ক্যান্সার’ নিয়ে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আয়োজনে ফ্রান্সে যে প্রোগ্রাম হয় সেখানে ৩১ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ মোবাইলের ক্ষতিকর দিক নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। মোবাইল ও টাওয়ার থেকে যে রেডিয়েশন হয় সে ব্যাপারে সবাই একমত, তবে সেটা কতটা ক্ষতিকর তা অনিশ্চিত।
সুতরাং টাওয়ারের বিষয়ে যেসব সতর্কতা বিবেচনা করা একান্ত জরুরি তা হলো :
(ক) প্রকৌশলগত দিক থেকে ভবনটি টাওয়ার বসানোর উপযোগী কি না;
(খ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড় বা ভূমিকম্পের সময় ভবনসহ আশপাশের ঘরবাড়ি কতটা নিরাপদ;
(গ) একই অঞ্চলে সর্বাধিক কতটা টাওয়ার বসানো নিরাপদ তা নির্ণয় করা এবং প্রয়োজনে কয়েকটি কোম্পানি যৌথভাবে একই টাওয়ার ব্যবহার করা যায় কি না তা বিবেচনা করা;
(ঘ) টাওয়ারের নিকটে আবাসিক ভবন, হাসপাতাল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেডিয়েশন ও ফ্রিকুয়েন্সি মেপে দেখে নিশ্চিত হওয়া উচিত যে তা নিরাপদ মাত্রায় আছে কি না;
(ঙ) টাওয়ার বসানোর সময় যেন সব নিয়মনীতি মেনে চলা হয় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
একজন সাধারণ সচেতন মানুষ হিসেবে টাওয়ারের প্রসঙ্গটি আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করলেও আমি যেহেতু এই বিষয়ের ছাত্র বা গবেষক নই, তাই সঠিক তথ্য উপাত্ত ও যুক্তিসহ উপস্থাপন করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্যই বটে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ছাত্র, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং সরকারি বেসরকারি দফতর যত দ্রুত সম্ভব তাদের প্রফেশনাল ও গবেষণালব্ধ তথ্যউপাত্ত সরবরাহ করে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে মোবাইল টাওয়ারের দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সংক্রান্ত উৎকন্ঠা থেকে দেশবাসীদের আশ্বস্ত করবে বলে আশা করি ।
[লেখক : জাপান প্রবাসী, শিক্ষক ও কলামিস্ট।]