সোমবার ● ১ জুলাই ২০১৩
প্রথম পাতা » খোলা কলম » ডিজিটাল ব্যানারে “বিষমুক্ত ও কেমিক্যালমুক্ত” আমে প্রতারনা
ডিজিটাল ব্যানারে “বিষমুক্ত ও কেমিক্যালমুক্ত” আমে প্রতারনা
ঢাকা শহরের আশে পাশে গড়ে উঠেছে এরূপ শত শত মৌসুমী ফল আম লিচুর বিক্রয়কেন্দ্র।আর এসব কেন্দ্রে সুন্দর ডিজিটাল ব্যানারে লিখা আছে বিষমুক্ত ও কেমিক্যালমুক্ত আম। এভাবেই আমরা যারা ভোক্তা এসব ফল ব্যবসায়ী কর্তৃক প্রতিনিয়ত ভাবে প্রতারিত হচ্ছি। এখন জৈষ্ঠ ও আষাঢ় এই দুমাস প্রচুর পরিমানে মৌসুমী ফলমুল বাজারে পাওয়া যায় যেমন আম, লিচু, আনারস, জাম ও কাঁঠাল। আর বেঁচে থাকার জন্য আমরা এধরনের ফল কিনছি ও খাচ্ছি।
আম গাছে যখন মুকুল আসে ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় কীটনাশক ও বালাইনাশক দিয়ে গাছে স্প্রে করানো। এরপর আম ধীরে ধীরে যতই বড় হতে থাকবে ততই স্প্রে দেওয়া চলতেই থাকবে। এমনকি ১০ থেকে ১৫ বার পর্যন্ত এই স্প্রে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রতিটি স্প্রে বোতলের লেবেল-এ উল্লেখ থাকে স্প্রে করানোর ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত মাঠ থেকে সংগ্রহ ও বিক্রয় করা যাবে না। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা স্প্রে করানোর ২-৩ দিনের মধ্যেই বাজারে বিক্রয় অথবা সরবরাহ করেন। পরবর্তীতে আমগুলি দীর্ঘদিন যাতে না পঁচে সে জন্য ফরমালিন দ্রবনে এগুলি ভিজিয়ে শুকনা করে ঝুড়িতে প্যাকেজিং করে বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উদাহরন স্বরুপ গত ১২ই জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত পরিবেশ বাঁচাও (পবা) আন্দোলনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে রাজধানীর ৯৪% আমের মধ্যে ফরমালিন এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পবা-র মতে এই সমীক্ষায়এটা নির্ভূল। বেশ কয়েক ধরনের আমের উপর পবা একটি সমীক্ষায় চালায় যেখানে পবা নিজ উদ্যোগে ফরমালিন সনাক্তকরনের জন্য একটি দামী যন্ত্র সংগ্রহ করে যে ফলাফল প্রতিবেদন পেশ করেছেন এই জন্য তারা প্রশংসার দাবীদার। কারন এ ধরনের উদ্যোগটা যে কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান অথবা স্বায়ত্বশাষিত প্রতিষ্ঠান গ্রহন করতে পারতো কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা সম্ভব হয়নি। ফরমালিন ও কীটনাশক অথবা বালাইনাশক এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সেটা আমরা জানি।
এইসব ফরমালিন মেশানো ফলমুল খাওয়ার পর বিষক্রিয়ায় ল ল শিশুদের মস্তিস্ক স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে পারছে না, অনেকের স্মরণশক্তিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গর্ভবতী মায়েদের শিশু অপুষ্টি ও বিকলাঙ্গ হতে পারে এমনকি ক্যান্সার নামক একটি মরন ব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে পারে এবং কিডনিগুলোও অকেজো হতে পারে। প্রায় প্রতিদিন এসব প্রতিবেদন সংবাদ মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ছে।
এখন আমি মনে করি একজন সাধারন ভোক্তা হিসেবে নিরাপদ ফল পাওয়া ও খাওয়ার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমরা সেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিটি সময় প্রতিটি ভোক্তার মধ্যে এই আতংক বিরাজ করছে, আমরা কি পয়সা দিয়ে বিষ মেশানো ফল কিনে খাচ্ছি? যার পরিণতির শিকার আমরা আর আমাদের পরিবার।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিষমুক্ত ও কেমিক্যালমুক্ত আম ও লিচুর বিক্রয়কেন্দ্র তৈরী করে দেদারছে বিক্রি করা হচ্ছে। এরা মৌসুমের ফল বিক্রেতা, বিক্রয় করছে করুক, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সাধারন ভোক্তাদের তারা কোনভাবে নিশ্চিন্ত করতে পারছে না ঐ ফলগুলির মধ্যে কোন মাত্রায় ফরমালিন বা কীটনাশকের উপস্থিতি নাই। কাজেই আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারছি এগুলো ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।
কিছুদিন পূর্বে পত্রিকায় দেখলাম এদেশের একটি বহুজাতিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন প্রতিষ্ঠান যাদের পন্য বিদেশের বাজারেও রপ্তানি হয় সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য ৯০ টন কাঁচা আমের স্লাইস যারমধ্যে ১৯০পিপিএম মাত্রায় ফরমালিন দিয়ে সংরন করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাৎনিক গিয়ে সে আমগুলি জব্দ করে জড়িতদের জেলে পাঠান। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক ফরমালিন মিশ্রিত আমের স্লাইস থেকে তৈরী হওয়া আচার খেয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন মরনব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারত। আমরা আমাদের নৈতিকতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের প্রশ্ন এদেশের এতবড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপকে কিভাবে গ্রহন করল সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। এটার অর্থ হলো পূর্ব থেকেই তারা এই কাজে অভ্যস্থ।
সরকার ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধ করার জন্য জাতীয় সংসদে ভেজাল বিরোধী আইন পাশ করেছেন এবং ১০টি মন্ত্রনালয়কে নিয়ে একটি শক্তিশালী দল গঠন করেছেন কিন্তু এইদলের কাজ মন্থর গতিতে চলছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ভেজাল কিছু পেলে সেটা ধ্বংস করে দিচ্ছেন অথবা জরিমানা করছেন। এই আইনটি ভেজালকারীর জন্য লঘু দন্ড। কারন সে জরিমানা দেয়ার পর আবারও ভোজাল কাজ শুরু করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে একজন ভেজালকারী জাতীয় শত্র”। কারন সে খাদ্যের মধ্যে ভেজাল মিশিয়ে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কাজেই এদের জন্য মৃত্যুদন্ডই একমাত্র শাস্তির বিধান হওয়া উচিত।একজন ভেজালকারী কেবল একজন লোককে হত্যা করছে না বরং সে জাতিকে তিলে তিলে নিরব গণহত্যা করছে। ভেজাল খাদ্য গ্রহনের ফলে প্রতিবছর ২ লক্ষ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। বারডেমের তথ্য অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮% অর্থ্যাৎ ১ লক্ষ প্রতিবছর লোক ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া ১ ল লোক কিডনি রোগে এবং ৩ লক্ষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
২০০৯ সালের ৫ই এপ্রিল জাতীয় সংসদে ভোক্তা অধিকার আইনটি পাশ হয় এবং পরবর্তিতে আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। আমি মনে করি ভোক্তার অধিকারের স্বার্থে এই আইনটি সংশোধন করে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিৎ। প্রতিটি ভোক্তা তার অধিকার হিসেবে নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার আশা করে। আমরাও চাই মানুষকে এই নিরব মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার নিমিত্তে নিরাপদ খাদ্যের জন্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
ডঃ কে এম ফরমুজুল হক
লেখক একজন গবেষক
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
নিউট্রিশান এন্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
ঢাকা।
- সম্পাদনায় তানিম