বুধবার ● ২৮ নভেম্বর ২০১২
প্রথম পাতা » আইসিটি আপডেট » এবার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘ !
এবার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘ !
ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে? রাশিয়া, চীন ও কিছু আরব রাষ্ট্র এর নিয়ন্ত্রণ ভার জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়ার পক্ষে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এশিয়ার বেশির ভাগ দেশসহ গুগলের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এর বিপক্ষে। কোনো সংস্থার কাছে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হলে তা এটির গতি রুদ্ধ করবে বলে মত পোষণ করছে এসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান। এমন অবস্থায় বিষয়টির সমাধান খুঁজতে আগামী সপ্তাহে দুবাইয়ে আলোচনায় বসবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার। খবর রয়টার্সের।
দুবাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়নের (আইটিইউ) অধীনে ১২ দিনের এ সম্মেলন শুরু হবে। ১৫৭ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে জাতিসংঘের একটি শাখা। আইটিইউর হাতেই ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিতে চায় রাশিয়া, চীন ও আরও কিছু উন্নয়নশীল দেশ। ইন্টারনেট থেকে মুনাফা তোলার পাশাপাশি প্রতিটি দেশের হাতে নিজস্ব ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেখতে চায় এসব দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানিগুলো চায় ইন্টারনেট যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক।
ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পক্ষে আনা প্রস্তাবগুলোর কড়া সমালোচনা করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও স্বাধীন মতবাদের পক্ষে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ইন্টারনেটের বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে তারা সোচ্চার।
সম্মেলনের আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার আইটিইউর কাছে ইন্টারনেটের বিষয়ে নিজেদের মতামত গোপনে জমা দিয়েছে। এসব দলিলের কিছু ফাঁস হওয়ায় জানা যায় রাশিয়া ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। তাদের দাবি, প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে ইন্টারনেটের কাঠামো দাঁড় করাক। প্রতিটি দেশের সীমারেখার মধ্যে থাকা ইন্টারনেটকে ওই দেশের সরকারের অধীনে রাখার পক্ষপাতী দেশটি। কিছু আরব রাষ্ট্র আইটিইউকে এক পরামর্শে জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী যত ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই একটি ভিন্ন পরিচয় থাকতে হবে। ওই পরিচয়ে যাতে সবসময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায়- এমন ব্যবস্থা চায় তারা। উন্নয়নশীল দেশ এবং কিছু টেলিকম প্রতিষ্ঠান চায় ইন্টারনেটের যেকোনো সেবা ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীরা অর্থ দিক।
১৯৩টি দেশের সংস্থা আইটিইউও চাইছে ইন্টারনেটের গতিপথ নির্ধারণ করতে। বর্তমানে ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ ভার কারও হাতে না থাকার বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না তারা। এ কারণে জাতিসংঘের সংস্থাটিও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। সম্মেলনে এ বিষয়টির পাশাপাশি আরও কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা হবে। বিভিন্ন দেশের টেলিকম কোম্পানির পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে থাকা চুক্তিটি হালনাগাদ করা হবে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে টেলিকমসেবা আরও ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হবে।
আইটিইউর সদস্য বেশির ভাগ দেশ যদি ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের কাজ জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়ার পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে তিক্ততার সূচনা হতে পারে বলে মনে করছে রয়টার্স। পশ্চিমা দেশগুলো বিষয়টি মেনে নেবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থাটি।
এ অবস্থায় গত সপ্তাহে সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এর সামাজিক যোগাযোগের সাইট গুগল প্লাসে মুক্ত ও স্বাধীন ইন্টারনেটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছেও বিষয়টি সম্পর্কে প্রচারণা চালাচ্ছে সাইটটি।
গুগলের কূটনীতি বিভাগে কাজ করা ভিন্ট সার্ফ ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তার ভাষায়, কিছু সরকার ও তাদের নিয়ন্ত্রিত টেলিকম অপারেটর ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য আইনটি চালু করতে চায়। রয়টার্সকে তিনি বলেন, এসব মানুষের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের অব্যাহত প্রচেষ্টা থেকে এটাই প্রমাণিত, তারা এখনো আদিম যুগে পড়ে আছে। তাদের কেবল ডাইনোসরের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। তাদের ছোট মস্তিষ্ক বিষয়টি ধরতে পারছে না। তারা বুঝতে পারছে না, এ ধরনের কোনো কিছু এখন অচল। তারা বুঝতে পারছে না, কারণ এসব বিষয় তাদের মাথায় ঢোকে না।
আইটিইউর মহাসচিব হামাদন তোরে রয়টার্সকে বলেন, এ ধরনের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হলে প্রায় সব দেশের ভোটই প্রয়োজন হবে। কোনো চুক্তি হালনাগাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ভোটে কাজ চলতে পারে। কিন্তু এটি অনেক বড় সিদ্ধান্ত।
রাশিয়ায় পড়াশোনা করা তোরে আরও বলেন, ভোটাভুটির অর্থ বিজয়ী ও বিজিত। আইটিইউ এ ধরনের কিছুর অবতারণা চায় না।
ইন্টারনেটের জন্য একটু হলেও নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া আরও একটি বিষয়ের সমালোচনা করেন তিনি। আইটিইউ এত দিন টেলিকম ক্যারিয়ারের মধ্যে সমঝোতা করে এসেছে। কিন্তু ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতা সংস্থাটির নেই বলে অনেকেই বলে আসছে। বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন তিনি। তার ভাষায়, রাস্তার মালিক আপনি। তার মানে এই নয় যে, রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ি এবং গাড়িতে থাকা মালপত্রের মালিকও আপনি। আবার আপনি হয়তো বা একটি গাড়ি কিনতে পারেন, কিন্তু রাস্তা আপনি কিনতে পারেন না। রাস্তা দিয়ে যে পরিমাণ গাড়ি যায় এবং এর জন্য যে রকম মজবুত রাস্তা থাকা দরকার, তা নিয়ে পরিকল্পনার প্রয়োজন। একই কারণে ইন্টারনেটের ট্রাফিকের জন্যও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
১৭টি আরব রাষ্ট্রের সমন্বিত দাবি মেনে নেয়া হলেও ঝামেলার সূত্রপাত হতে পারে। দেশগুলোর দাবি, প্রত্যেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটি বিশ্বজনীন পরিচয় থাকতে হবে। এ পরিচয় ছাড়া তারা ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারবে না। এমন কিছু করলে ভিন্ন মতাবলম্বীরা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও দুবাই সম্মেলনে মারাত্মক কোনো সিদ্ধান্ত আসবে না বলেই মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলিগেশন দলের প্রধান টেরি ক্রামার। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ঐক্যমতের ভিত্তিতেই নিতে হবে। আমরা ইন্টারনেটের স্বাধীনতার পক্ষে। ইউরোপ এবং এশিয়ায় চীন ছাড়া বেশির ভাগ দেশ আমাদের পক্ষে।’
ইন্টারনেট নিয়ে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন, অনেক দেশই এখন ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে এখন ইন্টারনেট ফিল্টার করা হচ্ছে বলে জানান টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রোনাল্ড ডেইবার্ট।
চলতি মাসে রাশিয়া ইন্টারনেটের জন্য কালোতালিকা নামে নতুন একটি আইন জারি করেছে। ক্ষতিকারক সাইটগুলোকে এ তালিকায় ফেলার মাধ্যমে তা রাশিয়ায় বন্ধ করে দেয়া হবে। এ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর দেশ চীনেও কঠোরভাবে ইন্টারনেট নজরদারি করা হয়।