রবিবার ● ৪ নভেম্বর ২০১২
প্রথম পাতা » @নারী » সাইকেলে ঘুরে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটসেবা
সাইকেলে ঘুরে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটসেবা
কয়েক বছর আগেও কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচয় ছিল না আমেনা বেগমের। আর এখন স্কাইপের মাধ্যমে প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলেন তিনি। বাইসাইকেলে করে এক নারী প্রতিদিন তার কাছে নিয়ে আসেন ইন্টারনেট।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশকিছু নারী, যারা ‘তথ্য আপা’ (ইনফো লেডিস) নামে পরিচিত; তারা ল্যাপটপের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দিচ্ছেন। বিশেষ করে নারীদের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছাতে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। সরকারি সেবা থেকে শুরু করে প্রবাসে থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে আলাপ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করছেন তারা। ১৫ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মাত্র ৫০ লাখ। এ অবস্থায় ইন্টারনেটের প্রসারতায় ভূমিকা রাখছেন এ নারীরা।
স্থানীয় উন্নয়ন গ্রুপ ডি নেটের উদ্যোগে ২০০৮ সালে গড়ে ওঠে ‘দি ইনফো লেডিস’ প্রকল্প। সেলফোনের প্রসারে জন্য নেয়া এক উদ্যোগের অনুকরণে গড়ে তোলা হয় এ প্রকল্প। কয়েক বছরের মধ্যে কয়েক হাজার নারীকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েছে ডি নেট।
নারীদের নির্বাচিত করার পর তাদেরকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেয় ডি নেট। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার ও ক্যামেরা চালানোর প্রশিক্ষণ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া নারীদের বাইসাইকেল ও কম্পিউটার সামগ্রী কিনতে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাও করেন তারা।
এ-সম্পর্কে ডি নেটের নির্বাহী পরিচালক অনন্য রায়হান বলেন, আমরা কর্মহীন নারীদের কর্মসংস্থান করছি। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি জানিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষমতায়ন করছি।
যেসব নারী এ ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার কাজ করেন, তারা সাধারণত গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। অল্পশিক্ষিত এ নারীরা এর মাধ্যমে যথেষ্ট অর্থও আয় করছেন। সৌদি আরবে থাকা স্বামীর সঙ্গে স্কাইপেতে কথা বলতে আমেনা বেগমকে প্রতি ঘণ্টায় খরচ করতে হয় ২০০ টাকা।
স্বামীর সঙ্গে ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। আগ্রহের সঙ্গে তাকে জানান, তার পাঠানো অর্থ তিনি পেয়েছেন। স্বামী তাকে পরামর্শ দেন কৃষিজমি কেনার। আমেনা বেগমের শাশুড়িও এখন তার ছেলের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন।
গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা আমেনা বেগম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘স্কাইপেতে কথা বলতেই আমার ভালো লাগে। এটা দিয়ে আমি তাকে দেখতে পাই।’
পাশের গ্রাম স্বাগতায় থাকা কিশোরী তামান্না ইসলাম দীপা ‘তথ্য আপা’দের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারছেন সামাজিক যোগাযোগের সাইট। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো কম্পিউটার নেই। তথ্য আপা আসলে আমি তার ল্যাপটপ দিয়ে আমার ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে পারি। ক্লাসের নোট বিনিময়ের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আমরা আলোচনা করি। বাল্যবিবাহ,
যৌতুক ও নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন নিয়ে আমরা কথা বলি।’
এসবের পাশাপাশি তথ্য আপারা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সেবাও দিয়ে থাকেন। কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও সমাজের বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে কথা বলেন। এ ছাড়া বয়োসন্ধিকালে নারীদের মধ্যে যে পরিবর্তন আসে, সেগুলো মোকাবেলার কথাও তারা জানান। দেশে নতুন প্রণীত আইন ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট’-এর অধীনে গ্রামবাসীদের বিভিন্ন তথ্য জানান তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে ওয়েবসাইটে অভিযোগও করতে পারছে গ্রামবাসীরা। কৃষকদের উপযুক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করতে তারা কথা বলেন। ১০ টাকার বিনিময়ে
অনলাইনে কলেজছাত্রদের আবেদনপত্র পূরণ করে দেন। এ ছাড়া রক্তচাপ ও রক্তে চিনির পরিমাণও মেপে দেন তারা।
অনন্য রায়হান বলেন, ইনফো লেডিসরা একই সঙ্গে উদ্যোক্তা এবং তারা সমাজে বিভিন্ন
সেবা প্রদান করছে।
এ ধরনের একটি পরিকল্পনা অনন্য রায়হানের মাথায় এসেছিল নোবেলবিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের একটি কাজ থেকে। ২০০৪ সালে ড. মোহাম্মদ ইউনূস গ্রামের নারীদের মধ্যে সেলফোন ব্যবহার প্রসারে কাজ করেন। গ্রামাঞ্চলে
এ জন্য তিনি প্রশিক্ষণ দেন ‘মোবাইল আপাদের’ (মোবাইল লেডিস)।
প্রকল্পটি ব্যাপকভাবে সফল হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ সেলফোন ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশের ৬৪টির মধ্যে ১৯টি জেলায় প্রায় ৬০ জন নারী ইনফো লেডি প্রকল্পে কাজ করছেন। ২০১৬ নাগাদ এ নারীদের সংখ্যা ১৫ হাজারে পৌঁছানোর ব্যাপারে আশাবাদী অনন্য রায়হান।
গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য আপাদের সুদমুক্ত ঋণ দিতে সম্মত হয়। ঋণের প্রথম ধাপে দেয়া হবে ১০ কোটি টাকা। আগামী ডিসেম্বর থেকে এ অর্থ ছাড় করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। রায়হান বলেন, দেশের বাইরে
থাকা মানুষদের দেশে অর্থ পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করছে ইনফো লেডিসরা।
প্রকল্পটি সম্পর্কে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিখাতের অন্যতম ব্যক্তিত্ব জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এটি খুবই ভালো একটি পরিকল্পনা। দেশের সর্বস্তরের লোকদের ওপর এটি প্রভাব ফেলছে।
এ প্রকল্পে কাজ করে লাভবান হচ্ছেন তথ্য আপারাও। আমিনা বেগম ও দীপার গ্রামে কাজ করা তথ্য আপা সাথী আখতার জানান, স্কুলে শিক্ষকতা করার চেয়ে এ কাজ করে বেশি অর্থ আয় করছি। ঋণ ও অন্য অর্থ পরিশোধের পর মাসে গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি।
তার ভাষায়, ‘আমরা শুধু আয় করছি না,
নারীদের ক্ষমতায়নেও কাজ করছি। এটা আমাদের আনন্দ দেয়।’