রবিবার ● ৪ নভেম্বর ২০১২
প্রথম পাতা » আইসিটি আপডেট » কমে যাচ্ছে পিসি বিক্রি, বাড়ছে ট্যাবলেট স্মার্টফোন
কমে যাচ্ছে পিসি বিক্রি, বাড়ছে ট্যাবলেট স্মার্টফোন
।।মোঃ আবদুস সালি।। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি উপহার দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকে। বলা যেতে পারে এখন রমরমা কম্পিউটিং ডিভাইসগুলোর বাজার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সারাবিশ্বে বেড়ে চলেছে কম্পিউটারের বিক্রি। তবে সম্প্রতি প্রযুক্তি গবেষণার দুটি প্রতিষ্ঠান আইএইচএস আইসাপ্লাই এবং আইসিডি জানিয়েছে, চলতি ২০১২ সালে এই ধারার বিপরীতেই কমে যাবে কম্পিউটারের বিক্রি। অথচ এর বিক্রি বাড়ার কথা। কেননা, বিশ্বে বুদ্ধিমান বা মেধাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মেধার দিক দিয়ে শিশুরাও ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান দুটো নানা হিসাব-নিকাশ করে দেখেছে, ২০১২ সালে এসে হ্রাস পাচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর চিপের বাজারও। এক প্রতিবেদনে আইসাপ্লাই জানায়, ২০১২ সালে প্রায় ০.১ শতাংশ হ্রাস পাবে সেমিকন্ডাক্টর চিপের বিক্রি। পরিমাণের দিক দিয়ে তা বেশ কম; কিন্তু মোটেই কম নয় এর গুরুত্ব বা তাৎপর্য।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে এবারই প্রথম আগের বছরের তুলনায় কমে যাচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর চিপের বিক্রি। ২০১২ সালের প্রথম দিকে আই সাপ্লাই ধারণা করেছিল, চলতি বছরে প্রায় ৩ শতাংশ বাড়বে সেমিকন্ডাক্টর চিপের বিক্রি। বিশ্লেষকরা বলেছেন, সেখান থেকে ০.১ শতাংশ বাজার কমে যাওয়াও সাধারণ বা মামুলি বিষয় নয়। অর্থাৎ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা আরও বলেছেন, পারসোনাল কম্পিউটার বা পিসির জন্য তৈরি চিপগুলো বিক্রি হ্রাস পাওয়ার কারণেই পড়ে গেছে এই নেতিবাচক প্রভাব।
এদিকে আইডিসির লোকেরা জানান, চলতি ২০১২ সালে সারাবিশ্বে পিসি বিক্রির পরিমাণ বাড়বে মাত্র ০.৯ শতাংশ প্রায়। এই পরিমাণে পিসি বিক্রি বাড়াও মামুলি বিষয় নয়। বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন এর কর্মকর্তারা। অবশ্য চলতি বছর মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটি ধারণা করেছিল, এ বছরে সারাবিশ্বে প্রায় পাঁচ শতাংশ বাড়বে পিসি বিক্রি। সেই তুলনায় ০.৯ শতাংশ বৃদ্ধির খবর রীতিমতো হতাশার। তারা আরও জানান, বছর অনুপাতে পিসি বিক্রি বাড়ার হিসাবে চলতি বছরের পরিমাণ যথেষ্ট কম। বলা হয়েছে, ২০১২ সালের একেবারে শুরুর দিকে পিসি বিক্রির পরিমাণ ছিল আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এই পরিমাণ আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে দ্বিতীয় চতুর্ভাগ থেকেই। তারা এমনও বলেছেন যে, সামনে যে অল্প কয়েক মাস সময় আছে সেই সময়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়াও সহজ বিষয় নয়। উইন্ডোজ৮-এর ব্যাপারে অনেক আশা-ভরসা ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু সেটিও এক্ষেত্রে তেমনভাবে এগিয়ে আসতে পারছে না। এমন মন্তব্য করেছে আইডিসি। প্রতিষ্ঠান এইচপি জানিয়েছে, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে তাদের পিসি বিক্রি হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এইচপি হল পিসি তৈরিতে বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। এর কর্মকর্তারা আরও বলেন, বিশ্বে পিসি বিক্রিতে প্রতিযোগিতা বাড়লেও এতে কমবেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট পিসি ইত্যাদির বিক্রি বেড়ে যাওয়ার কারণেই। উইন্ডোজের (৮) জন্য অপেক্ষাও এর কারণ। তবে অনেকেই ধারণা করছেন, ২০১৩ সালে ঘুরে দাঁড়াতে পারে বিশ্বে পিসির বাজার। এজন্য আগে থেকেই এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এর সঙ্গে জড়িতদের।
পিসি তৈরি ও বিক্রির দিক থেকে এখন হিউলেট প্যাকার্ডকে পেছনে ফেলে দিতে সক্ষম হয় চীনা প্রতিষ্ঠান লেনোভো। সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনার। গার্টনারের হিসাব মতে, চলতি ২০১২ সালের প্রথম ৯ মাসে হিউলেট প্যাকার্ড বা এইচপি বিভিন্ন দেশে রফতানি করেছে প্রায় আট কোটি ৭৫ লাখ পিসি, যা ২০১১ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ কম। এদিকে লেনোভো চলতি বছর হিউলেট প্যাকার্ডের তুলনায় বেশি পারসোনাল কম্পিউটার রফতানি করেছে বিভিন্ন দেশে। পিসির মার্কেটে লেনোভোর অংশীদারী বর্তমানে প্রায় ১৬ শতাংশ। এইচপির দখলে রয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। গার্টনার বলেছে, তৃতীয় স্থানে রয়েছে ডেল। এর বাজার প্রায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে যথাক্রমে তাইওয়ানের এসার ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও আসুস ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে গার্টনার জানায়, সার্বিকভাবে কমে গেছে পিসি বিক্রি। ২০১১ সালে সারাবিশ্বে পিসি বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৩৫ কোটি ২৮ লাখ। চলতি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত যে পরিমাণ পিসি বিক্রি হয়েছে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, চলতি বছর ৩৪ কোটি ৮৭ লাখ ইউনিটের বেশি বিক্রি হওয়ার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএইচএসআই সাপ্লাই জানায়, দীর্ঘ ১১ বছরের মধ্যে এবারই কমতির দিকে পিসির বিক্রি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, পিসি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ আছে। মানুষের আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনের প্রতি। কারণ এগুলো সহজে বহনযোগ্য, কাজের সুবিধা বেশি, দেখতে সুন্দর এবং অনেক ক্ষেত্রে দামেও সাশ্রয়ী। এগুলো চালালে বিদ্যুৎও কম খরচ হয়। অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, ২০১৬ সালের মধ্যে পিসির বিক্রিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ট্যাবলেট কম্পিউটারের বিক্রি। তবে এ কথাও টিক যে সহসা হারিয়ে যাবে না পারসোনাল কম্পিউটার। যদিও এটি রাজত্ব হারাচ্ছে প্রযুক্তি বিশ্বে। প্রায় তিন বছর আগেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ছিল মাইক্রোসফট। আর এখন এসব প্রায় ভুলে গিয়ে এসবের ব্যবহারকারীরা বলছেন অ্যাপল এবং গুগলের কথা। আর মাইক্রোসফট শেষ পর্যন্ত নেমে এসেছে তৃতীয় স্থানে। এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে মাইক্রোসফটকে। এমন কি হিউলেট পেকার্ড বা এইচপি এবং ডেল-এর বাজার দখল করে নিচ্ছে ট্যাবলেট ও স্মার্টফোন।
আইডিসি (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান) সম্প্রতি জানিয়েছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে পিসি বিক্রি হয় প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ইউনিট, যা ২০১১ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম। ৯৬ দশমিক ০৮ মিলিয়ন ইউনিট পিসি বিক্রি হয় ২০১১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে। যদিও আইডিসি বলেছিল, প্রায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস পাবে এর বিক্রি। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র বিশ্লেষক জে চুউ মন্তব্য করেন, দ্রুত পড়ছে পিসির বাজার। তিনি আরও বলেন, মনে করা হয়েছিল বাজার বড় ভাবে পড়বে দ্বিতীয় প্রান্তিকে। এখন দেখা যায়, বড় ধাক্কা এসেছে তৃতীয় প্রান্তিকেও। এতে ধরে নেয়া যায়, এর পরও এর ধাক্কা কমবেশি থাকবে। ক্রেতাদের পছন্দ হওয়া ট্যাবলেট দ্রুত খেয়ে ফেলেছে পিসির বাজারÑ বলেছে প্রতিষ্ঠানটির আরেক বিশ্লেষক ডেভিড দাউদ। তবে জাপানে পিসি বিক্রির অবস্থা ভালো।
ট্যাবলেটের ব্যাপারে গবেষকরা বলেন, চলতি ২০১২ সালে ট্যাবলেটের বাজার অতিক্রম করবে ১০ কোটি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবিআই বলেছে, ২০১২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে নতুন রেকর্ড গড়ে ট্যাবলেট শিপমেন্ট। প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ ইউনিট ট্যাবলেট চালান হয় বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। আর এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৭ শতাংশ বেশি। এবিআইয়ের প্রাইমারি রিপোর্ট বলেছে, মোট চালানের প্রায় ৬৯ শতাংশই অ্যাপেলের আইপ্যাড। প্রতিষ্ঠানটির বিশ্লেষক জেফ ওর বলেছেন, ২০১০ সালে সব কোম্পানির ট্যাবলেট চালান যায় ১৭ মিলিয়নের সামান্য বেশি। আর ২০১২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অ্যাপল একাই চালান করেছে প্রায় ১৭ মিলিয়ন। বলা যেতে পারে, এটি ট্যাবলেট সংক্রান্ত একটি অত্যন্ত ভালো খবর। ওর মন্তব্য করেন, চলতি বছর সারাবিশ্বে ট্যাবলেট চালান হবে সর্বোচ্চ প্রায় ১১ কোটি। এদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবিআই-এর মতে ২০১৬ সালের মধ্যে ট্যাবলেট কম্পিউটার অতিক্রম করবে নোটবুক পিসির বাজার। এর প্রধান কারণ হল আইপ্যাডের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউর বলেছে, আমেরিকান বয়স্কদের ৮৫ শতাংশের রয়েছে একটি মোবাইল বা সেলফোন। আর ৪৫ শতাংশের রয়েছে একটি স্মার্টফোন। ১৮ শতাংশের রয়েছে ট্যাবলেট কম্পিউটার। এখন রমরমা ব্যবসা চলছে স্মার্টফোনের বাজারেও। গেল সেপ্টেম্বরে বাজারে এসেছে অ্যাপেলের আইফোন-৫। ওই সময়ে তা বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ ইউনিট। এদিকে ফোর্বস ম্যাগাজিন এসব নিয়ে জরিপ চালায়। তাতে এর লোকেরা দেখেছেন, অ্যাপল এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। স্মার্টফোনের বাজার থেকে এসেছে এ অর্জন। স্যামসাং এখন মোবাইল ফোনের বড় কোম্পানি। এর মূলে রয়েছে স্মার্টফোন বিক্রি। তবে কিছু কোম্পানি টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে পিসির এই মন্দা বা খারাপ বাজারেও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এইচপি বিক্রিতে সবচেয়ে এগিয়ে থেকে মার্কেট শেয়ার ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। চীনা কোম্পানি লেনোভা রয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ হল এর মার্কেট শেয়ার। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ডেল। এর মার্কেট শেয়ার ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বলে জানা গেছে। শপিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে স্মার্টফোন। জেভেলিন স্ট্র্যাটেজি সম্প্রতি জানিয়েছে, বর্তমানে স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের বিকিকিনি চলে। এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, স্মার্টফোনের চেয়ে ট্যাবলেট পণ্যতে অনলাইন কেনাকাটার চাহিদা বাড়ছে। কেননা, বড় পর্দায় দেখা যায় পছন্দসই পণ্যকে। এটি একটি বাড়তি সুবিধা। যে কারণে শুধু ট্যাবলেট পণ্যের মাধ্যমেই অনলাইন বিকিকিনি হয় প্রায় পাঁচশ কোটি ডলারের। জেভলিনের নির্বাহী সহ-সভাপতি এবং পণ্য গবেষণা পরিচালক ম্যারি মনাহান জানিয়েছেন, সারাবিশ্বেই ব্যাপক হারে বাড়ছে অনলাইনে কেনাকাটা। বিপণন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বিকিকিনি শিল্পের জন্য সৃজনশীল অ্যাপও। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্মার্টফোনের চেয়ে ট্যাবের মাধ্যমেই বেশি হচ্ছে বিকিকিনি। বছরে দুই হাজার কোটি ডলারের বিকিকিনি মামুলি বিষয় নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় দেড় হজার কোটি ডলার ট্যাবলেট বিকিকিনি তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়েই ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে অনলাইন বিকিকিনির বাজার। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেছেন, এসব ফোনসেট দিয়ে রোগ নির্ণয়সহ আরও অনেক ধরনের কাজ করার গবেষণা চলছে। তখন এসবের বিক্রি বা ব্যবহার যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে বিকিকিনি বা বাজার।