বুধবার ● ৩ আগস্ট ২০১১
প্রথম পাতা » খোলা কলম » শিক্ষানীতিতে নতুন শিক্ষাস্তরের সার্থকতা কোথায়
শিক্ষানীতিতে নতুন শিক্ষাস্তরের সার্থকতা কোথায়
মাহফুজুর রহমান মানিক:
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সংক্রান্ত সর্বশেষ সংবাদ হলো- শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২৬ জানুয়ারি ২০১১-তে গঠিত ২৪টি উপকমিটির একটি কমিটিও তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি (সমকাল, ২৫ জুলাই)। যে প্রতিবেদন কমিটিগুলোকে ২-৩ মাসের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। পাঁচ মাস পরও তারা তা জমা দিতে পারেনি। আর এভাবে এ শিক্ষানীতি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দু’বছরেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছে। এর আগে ২০০৯-এর ৪ এপ্রিল শিক্ষানীতি কমিটি গঠন, ২০০৯ এর ২ সেপ্টেম্বর কমিটির খসড়া শিক্ষানীতি প্রকাশ, ২০১০-এর ৩১ মে শিক্ষানীতি চূড়ান্তকরণ এবং মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন, আর ২০১০-এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে তা পাস করা হয়।
যাহোক এ শিক্ষানীতি সব প্রক্রিয়া শেষে এখন বাস্তবায়নের পথে। শিক্ষানীতি মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদসহ সবপর্যায়ে অনুমোদন পেয়েছে মানে এর নতুন স্তরবিন্যাসেরই অনুমোদন। বলা চলে শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কিংবা সবার কাছে নতুন শিক্ষানীতি বোঝার জন্য এ স্তরবিন্যাসটা সহজ বিষয়। আগের শিক্ষাস্তরগুলো হলো- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। এখন আর উচ্চ মাধ্যমিক থাকছে না। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এখন হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আর মাধ্যমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীর পর হতে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত।
নতুন এ স্তরবিন্যাসের সার্থকতা কতটা তা পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে দেখা যাক। এখানে পরীক্ষা মানে পাবলিক পরীক্ষা। আগে উচ্চশিক্ষার পূর্বে পাবলিক পরীক্ষা ছিল দু’টি, এসএসসি ও এইচএসসি। এখন পাবলিক পরীক্ষা দাঁড়িয়েছে চারটিতে, পঞ্চম শ্রেণীর পর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর পর জেএসসি, আর এসএসসি এবং এইচএসসি তো আছেই।
পঞ্চম শ্রেণীর পর সমাপনী আর অষ্টম শ্রেণীর পর জেএসএসসির যৌক্তিকতা কী। বর্তমান শিক্ষাস্তরের সঙ্গে মিলিয়ে যদি বলি_ পঞ্চম শ্রেণীর পর প্রাথমিক শিক্ষার সমাপনী হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী। যদি তা-ই হয় তবে অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি কী? এবার জেএসসিকে যদি বলি ভবিষ্যৎ প্রাথমিক শিক্ষার সমাপনী (যখন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হবে)। তবে পঞ্চম শ্রেণীর পর সমাপনীর আর দরকার কী?।
শিক্ষানীতিতে দেখা যাক। শিক্ষানীতির একুশতম অধ্যায় ‘পরীক্ষা ও মূল্যায়ন’। অধ্যায়টিতে পনেরটি কৌশল আছে। পাঁচ নম্বর কৌশলটি হলো_ ‘পঞ্চম শ্রেণী শেষে উপজেলা/পৌরসভা/থানা (বড় বড় শহর) পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।’
ছয় নম্বর কৌশল_ ‘অষ্টম শ্রেণী শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আপাতত এ পরীক্ষার নাম হবে জুনিয়র সার্টিফিকেট (ঔ.ঝ.ঈ) পরীক্ষা।’
আট নম্বর কৌশল_ ‘দশম শ্রেণী শেষে জাতীয় ভিত্তিতে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ পরীক্ষার নাম হবে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (ঝ.ঝ.ঈ) পরীক্ষা। দ্বাদশ শ্রেণীর শেষে আরও একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, এর নাম হবে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (ঐ.ঝ.ঈ) পরীক্ষা।’
শিক্ষানীতির নতুন স্তরবিন্যাসের অসারতা বা অপ্রয়োজনীয়তা আসলে এখানেই। মুখে মুখে বা কাগজে কলমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বললেও আসলে উচ্চ মাধ্যমিক ঠিকই থাকছে। কারণ আগের মতোই মাধ্যমিকের পর এসএসসি পরীক্ষা হচ্ছে আর উচ্চ মাধ্যমিকের পর এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছে। এছাড়া প্রাথমিকের পর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতো আছেই। তাহলে শিক্ষার নতুন স্তরবিন্যাসের কার্যকারিতা কোথায়?
আর যদি নতুন স্তর ধরি, অষ্টম শ্রেণীর পর জেএসসি ঠিক আছে প্রাথমিক শিক্ষার সমাপনী হিসেবে। আর মাধ্যমিকের পর এইচএসসি থাকবে মাধ্যমিক শিক্ষার সমাপনী হিসেবে। তাহলে শুধু শুধু পঞ্চম শ্রেণীর পর সমাপনী আর দশম শ্রেণীর পর এসএসসি কেন?
এসব পরীক্ষা খুব বড় বিতর্কের বিষয় তা কিন্তু নয়। তবে সবকিছু মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো এতবেশি পাবলিক পরীক্ষা পৃথিবীতে কমই আছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত। বই মুখস্থ করে পরীক্ষা দিচ্ছে। পাস করছে। জ্ঞানার্জন বলতে কিছুই হচ্ছে না। যদিও শিক্ষানীতি পরীক্ষার্থীর মুখস্থকরণকে নিরুৎসাহিত করে সৃজনশীলতার কথা বলেছে। এত চাপে শিক্ষার্থী কিভাবে সৃজনশীল হবে তা বোঝা মুশকিল।
এতবেশি পরীক্ষা না নিয়ে, শিক্ষার স্তর ঠিক করে, স্তর অনুযায়ী সমাপনী পরীক্ষা নিলেও অনেকটা চাপ কমবে। এক্ষেত্রে নতুন শিক্ষানীতি উচ্চশিক্ষার আগে যে স্তরবিন্যাস করেছে, সে অনুযায়ী পরীক্ষা হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর তথা অষ্টম শ্রেণীর পর হবে জেএসসি পরীক্ষা। আর মাধ্যমিক স্তর তথা দ্বাদশ শ্রেণীর পর হবে এইচএসসি পরীক্ষা। মাঝখানে পঞ্চম শ্রেণীর পর সমাপনীর দরকার নেই। আর দরকার নেই এসএসসিরও।
একথা ঠিক এ শিক্ষানীতি নতুন শিক্ষার স্তরবিন্যাস করলেও পরীক্ষার ক্ষেত্রে আগের পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছে। যেমন পঞ্চম শ্রেণীর পর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, দশম শ্রেণীর পর এসএসসি। এগুলো থাকার ফলে নতুন স্তরবিন্যাসের আর কোন যৌক্তিকতা রইল না। ফলে এখন আগের বিন্যাসেই শিক্ষাস্তর থাকাটা ভালো। মাঝখানে শুরু হওয়া অষ্টম শ্রেণীর পর জেএসসি বাদ দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে।
মজার বিষয় হলো_ এ অষ্টম শ্রেণীর পর সমাপনী পরীক্ষার ব্যাপারে শিক্ষানীতিতে একটা ছাড় লক্ষণীয়। শিক্ষানীতির ‘পরীক্ষা ও মূল্যায়ন’ অধ্যায়ের সাত নম্বর কৌশলটি তা বলে দেয়_ ‘যেসব শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের একটি কোর্স সমাপ্তি সনদপত্র প্রদান করবে এবং শিক্ষার্থীর আন্তঃপরীক্ষা ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের ফলাফল জন্ম তারিখসহ ওই সনদপত্রে লিপিবদ্ধ থাকবে।’ ফলে স্বাভাবিকভাবেই অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি বাদ দেয়াটা তেমন কোন সমস্যাই না।
আর আগের শিক্ষাস্তরের আরেকটা সুবিধাও আছে। সেটা হলো_ পরীক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ এসএসসি ‘ও’ লেভেল, এইচএসসি ‘এ’ লেভেল। ফলে আগের স্তরে ফিরিয়ে যাওয়া তেমন কোন ব্যাপার না। অন্যথায় একদিকে স্তরবিন্যাসের জটিলতা। অন্যদিকে চার চারটি পাবলিক পরীক্ষার ভার শিক্ষার্থীদের সইতে হবে।
বলার বিষয় হলো_ ২০১২ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণী থেকে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার কথা। আর এর জন্যও একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদারকে সভাপতি করে এ কমিটি গঠন করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণী থেকে কিভাবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করা যায়, তার বাস্তবায়ন কৌশল কী হবে, তা জানিয়ে কমিটিকে দু’মাসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন পেশ করার কথা বলা হয়। দু’মাসের জায়গায় এখন পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও কমিটি কোন প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি (নিউএজ, ৩ জুলাই)। এ কমিটির প্রধান সমস্যা হলো_ ঠিক কিভাবে নতুন স্তর অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাবে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
বাংলাদেশের এ অবস্থায় নতুন স্তর করা জটিলই। কার্যত যেহেতু এ নতুন স্তরবিন্যাসে শিক্ষার্থীদের বেশি পরীক্ষা দেয়া ছাড়া কোন সার্থকতা নেই, সেহেতু আগের স্তরবিন্যাস রাখা যেতে পারে।
[লেখক : শিক্ষা গবেষক।]