বৃহস্পতিবার ● ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » আইসিটি সংবাদ » বিগত সরকারের সময় প্রভাব খাটিয়ে সব উপবৃত্তি নগদে
বিগত সরকারের সময় প্রভাব খাটিয়ে সব উপবৃত্তি নগদে
মোহাম্মদ কাওছার উদ্দীন
বিগত সরকারের প্রভাব, ডাক বিভাগের প্রতিষ্ঠানের ব্যানার ব্যবহার করে দেশের সব সরকারি উপবৃত্তি বিতরণের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে নগদ। উপবৃত্তি বিতরণে অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, গ্রাহকদের ভোগান্তি কোনোকিছুই তাদের উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্বকে বাতিল করাতে পারেনি।
এমনকি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক- উভয় ক্ষেত্রে উপবৃত্তি গ্রহণকারীদেরকে তার পছন্দ অনুযায়ী মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা নেওয়ার আদর্শ পদ্ধতিকে বাতিল করে এককভাবে বিতরণের সুবিধা নিয়েছে নগদ। নগদকে এককভাবে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম টেন্ডার বা পদ্ধতিগত ধাপ অনুসরণ করা হয়নি।
৫ বছরের জন্য এককভাবে উপবৃত্তি বিতরণে নগদ: কোনো ধরণের নিয়ম না মেনেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে গত বছর মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদকে ৫ বছরের জন্য প্রাথমিকের ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির কাজ দেয়া হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছরের জন্য ডাক অধিদপ্তর ও নগদের সঙ্গে উপবৃত্তি বিতরণে চুক্তি কর হয়। ডাক বিভাগের সাথে চুক্তির কথা বলা হলেও, আদতে নগদের মালিকানায় নেই ডাক বিভাগ। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে উপবৃত্তি সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীদের মা-বাবা ও বৈধ অভিভাবকের পছন্দ অনুযায়ী তাদের সক্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হবে মর্মে উল্লেখ করে একটি নির্দেশিকা জারি হয়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে উপবৃত্তির প্রাপ্তের পছন্দ বাদ দিয়ে নগদকে এককভাবে কাজ দেয়া হয়েছিল। এমনকি এককভাবে কাজ দেয়ার চিঠিতে তৎকালীন প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রী এবং সচিবের মতামতের ভিত্তিতে কাজ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করা হয়।
মাধ্যমিকে উপবৃত্তি বিতরণের কাজ নগদকে দিতে ভাঙ্গা হয় দীর্ঘদিনের নিয়ম, বিতরণ নিয়ে শংকা: ২০২০ সাল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সকল উপবৃত্তি কার্যক্রম প্রধামমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে পরিচালনা করা হতো। এর অধীনে অভিভাবকদের পছন্দের মোবাইল আর্থিক সেবা (বিকাশ, রকেট, নগদ, শিওরক্যাশ) অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তি প্রদান করা হতো। কিন্তু, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে উপকারভোগী এবং তাদের অভিভাবকদের মতামত উপেক্ষা করে পছন্দের মোবাইল ব্যাংকিং নাম্বারে উপবৃত্তি পাঠানোর পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনায় এককভাবে নগদ-এর মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে, সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচিতে মাধ্যমিক হতে স্নাতক বা সমমান পর্যায়ের ৬৪ লাখ ৭০ হাজারের উপর শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি বিতরণে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। এছাড়াও, উপবৃত্তি বিতরণে সক্ষমতার অভাব, প্রতারণা, ভুয়া এবং ভুল অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির অর্থ পাঠানোর অভিযোগও উঠেছে নগদ-এর বিরুদ্ধে। কোন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হবে তা নিয়ে বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণেই এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতাধীন সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির অধীনে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সব অনলাইন ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ‘নগদ’-এ রূপান্তর করার নির্দেশনার পর থেকেই এই কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এ বছরের ৩০ জানুয়ারি সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় উপবৃত্তিপ্রাপ্ত, উপবৃত্তির জন্য নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাধ্যমিক হতে স্নাতক বা সমমান পর্যায়ের অনলাইন ব্যাংক (এজেন্ট ব্যাংকিংসহ) এবং নগদ হিসাবধারী ব্যতীত অন্যান্য মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ সংখ্যাক উপকারভোগীর মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নাম্বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকে এইচএসপি-এমআইপি সফটওয়্যার-এর মাধ্যমে নগদ-এ রূপান্তর করার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রনালয়। কিন্তু, পর পর চারবার সময় বাড়ানোর পরেও উপকারভোগীদের অন্যান্য এমএফএস অ্যাকাউন্টগুলো পুরোপরি নগদ-এ রূপান্তর করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ১১ জুন এক বিজ্ঞপ্তিতে অ্যাকাউন্ট রূপান্তরের শেষ সময় বেধে দেয়া হয়েছিলো গত ২৭ জুন।
তবে, নগদ-এ অ্যাকাউন্ট রূপান্তর কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আবারও ব্যর্থ হওয়ায় সম্ভাবনা থাকায়, নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার আগেই গত ২২ জুন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বলা হয়, যেসকল শিক্ষার্থীদের অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তর করা সম্ভব হয়নি তাদের উপবৃত্তির অর্থ যাতে পূর্বের এমএফএস অ্যাকাউন্টেই বিতরণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, সঠিক সময়ে সকল অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তর করতে না পারায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ১৯,৪৪,৫৯১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০২৪ সালে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া ৫,৩২,৩৭৫ জন শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার কারণে এইচএসপি-এমআইএস সফটওয়্যারে তাদের আইডি নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে।
নগদ সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই ব্যর্থতার ফলে বহু শিক্ষার্থী যেমন উপবৃত্তির তালিকা থেকে বাদ পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন, একই ভাবে নগদ-এর উপবৃত্তি বিতরণের সক্ষমতা সহ এই প্রক্রিয়ায় প্রতারণা, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্নও উঠছে। আরো অভিযোগ রয়েছে, নগদ থেকে মূল উপকারভোগীকে উপবৃত্তির টাকা না পাঠিয়ে ভুয়া এবং ভুল নাম্বারে টাকা পাঠানোর। অনেক অভিভাবক দাবি জানিয়েছেন, আগের মতোই যার যার পছন্দের এমএফএস হিসাবে যাতে উপবৃত্তির অর্থ প্রদান করা হয়। অনেক অভিভাবকই মনে করছেন, জোর করে চাপিয়ে দেয়া নগদ অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তি প্রদান করার পর ক্যাশ আউটের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় এজেন্ট নেটওয়ার্ক ও তাদের সক্ষমতারও অভাব প্রকট হয়ে ওঠে।
সুনামগঞ্জের আবদুর রশীদ উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নগদের মাধ্যমের উপবৃত্তির টাকা দেওয়াকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, গ্রামের ৯৫% মানুষ কেওয়াইসি ভেরিফিকেশন সম্পর্কে জানে না। এর কারণে কেওয়াইসি ভেরিফিকেশনের সাথে মিল না থাকায় অনেক তথ্য ঠিক থাকার পর ভেরিফায়েড হয় না। যার কারণে অনেকে উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আগে উপবৃত্তির টাকা বিকাশের মাধ্যমে দেয়া হত, বারবার যাতে এটা পরিবর্তন করা না হয় তার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি এক প্রোগ্রামে, শিক্ষক নেতা জাহাঙ্গীর বলেন, আগে বিকাশের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা দেয়া হত, যা পরিবর্তন করে বর্তমানে নগদের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। তাই অভিভাবকরা বিভ্রান্ত হয়ে যান। এক স্কুলে উপবৃত্তি পাওয়া ৫৯ জনের মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পাননি। কারণ, সার্ভার এ একাউন্ট ট্রান্সফার করে নগদে নিতে বলা হয়েছে, এতে অভিভাবকরা কনফিউজড হয়ে গেছেন। আবার অনেকে নগদ নাম্বার দেয়ার পরও তারা টাকা পাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, গত ২৪ জুন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাধ্যমিক থেকে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে নগদ-এর মাধ্যমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেছিলেন। সারাদেশে ষষ্ঠ থেকে স্নাতক ও সমমান পর্যায়ে অধ্যয়নরত ৬৪ লাখ ৭০ হাজার ৭১ জন উপবৃত্তিপ্রাপ্ত অস্বচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বাবদ ২,২০৮ কোটি ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫ টাকা জিটুপি পদ্ধতিতে মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ-এর মাধ্যমে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া সদ্যবিদায়ী সরকার।