সোমবার ● ৪ নভেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » ডিজিটাল বাংলা » কম্পিউটার বিপ্লবের জাতীয় বীর হানিফউদ্দিন মিয়া
কম্পিউটার বিপ্লবের জাতীয় বীর হানিফউদ্দিন মিয়া
মোস্তাফা জব্বার: ২০১৯ সালের ১ নবেম্বর, শুক্রবার আমরা পালন করলাম মরহুম হানিফউদ্দিন মিয়ার নব্বুইতম জন্মবার্ষিকী। ২০২৯ সালে পালিত হবে তার জন্মশতবার্ষিকী। দিনটি শুক্রবার বিধায় জন্মজয়ন্তীটি আমরা পালন করি তার আগের দিন ৩১ অক্টোবর। মিডিয়ার খবর : ‘ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার সূচনা সম্ভব হতো না যদি ১৯৬৪ সালে এই অঞ্চলের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মোঃ হানিফউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে কম্পিউটার না আসত। সেই সময়ে একটি মাত্র আইবিএম ১৬২০ মডেলের কম্পিউটার থেকে হানিফউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে একটি তথ্যপ্রযুক্তি কমিউনিটির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কম্পিউটার। তিনি হানিফউদ্দিন মিয়াকে কম্পিউটার বিপ্লবের জাতীয় বীর আখ্যায়িত করে তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
মন্ত্রী ঢাকায় ডাক অধিদফতর মিলনায়তনে বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মোহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়া স্মরণে বাংলাদেশ ডাক অধিদফতর কর্তৃক স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম এবং তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শরীফ হাসানসহ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আজিজুল ইসলাম ও ডাক অধিদফতরের মহাপরিচালক সুধাংশু কুমার ভদ্র উপস্থিত ছিলেন।
টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেন, প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বে আজ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এখনও অনেকে জানেন না যে, বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার কে। এমনকি যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে তারাও জানে না যে কার হাত ধরে ‘৬৪ সালে আমরা কম্পিউটারের যুগে পা ফেলেছিলাম। মানুষটি যেমনি বিস্মৃত তেমনি ঘটনাটিও। ‘৯৭ সালের মে মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম আমাকে কম্পিউটার বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করার অনুমতি প্রদান করে। আমি ‘৬৪ সালে বাংলাদেশে আসা প্রথম কম্পিউটার নিয়ে আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠানটি সাজাই হানিফউদ্দিন মিয়ার সাক্ষাতকার দিয়ে। সেই সাক্ষাতকারটি ছিল বাংলাদেশের কম্পিউটারের ইতিহাসে এক বড় ধরনের মাইলফলক। কারণ হানিফউদ্দিন সেদিন বলেছিলেন এ দেশে কম্পিউটার আসার কথা। তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের লাহোরে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা কম্পিউটারটি পাই। বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হানিফউদ্দিন মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো-২০১৫ শীর্ষক মেলার সমাপনী আয়োজনে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ আজিজুল ইসলামের সভাপত্বিত্বে অনুষ্ঠানে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক এসএস ভদ্র বক্তৃতা করেন।’
আমার এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য ইতোপূর্বে আলোচিত বাংলাদেশের প্রথম প্রোগ্রামার মোঃ হানিফউদ্দিন মিয়ার জন্মের ৯০ বর্ষপূতিতে শ্রদ্ধা জানানো। ১লা নবেম্বর ১৯২৯ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আমি তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শুরু করি ১৯৯৭ সালে। সেই বছর মে মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত কম্পিউটার অনুষ্ঠানে আমি তার প্রথম ও একমাত্র সাক্ষাতকার সম্প্রচার করেছিলাম। তার জীবদ্দশায় তার আর কোন সাক্ষাতকারের কথা আমি জানিনা। এবার ২০১৯ সালে আমাদের ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা তাকে স্মরণ করে একটি স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করেছি। এর আগে ২০১৫ সালে তাকে আমরা আজীবন সম্মাননা প্রদান করি।
২০১৯ সালের শুরুতে নাটোরের সিংড়া যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের কাছ থেকে। তিনি সিংড়া থানার ১৫০ বছর উদযাপন করবেন বলে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই সিংড়া গিয়েছিলাম। পলক এর সিংড়া উপজেলা সদরের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে আমি দাবি করেছিলাম যে হুলহুলিয়া গ্রামে যাব। পলকের সঙ্গে সিংড়া যাব এমন আলাপ করার সময়েই আমি এই দাবিটি তুলেছিলাম। পলক তাতে রাজি হয়েছিলেন। সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নও করেছি আমরা। তবে একটু দেরিতে গিয়েছিলাম হুলহুলিয়া গ্রামে। সিংড়ার অনুষ্ঠান শেষ করতে দেরি হওয়ার ফলে হুলহুলিয়া পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে যায়। আমার সঙ্গী ছিলেন পলক নিজে এবং বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জেসমিন জুঁই ও তার মেয়ে ফাবিহা তাবাসসুম পরমা। দেরিতে যাবার পরও সেখানে গিয়ে আমরা স্তম্ভিত। হানিফউদ্দিন মিয়ার কবরের কাছেই একটি মাঠে প্যান্ডেল টানিয়ে মঞ্চ সাজিয়ে গ্রামবাসী একটি বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমি বিকেলে যাব জেনে তারা সেই বিকেল থেকে রাত অবধি বসা। হানিফউদ্দিনের ছেলে সুজাও ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমরা হানিফউদ্দিন মিয়ার প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানিয়ে তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করে বিদায় নিলাম। ফেরার পথে দেখলাম সড়ক থেকে কিছুটা দূরে হানিফউদ্দিন মিয়ার মাজার রয়েছে। কষ্ট হলো মাজারটি জেয়ারত করতে পারিনি বলে। তবে শান্তি পেলাম একজন পূর্ব পুরুষের প্রতি তার গ্রামে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি ভেবে। ভাবছি অন্য কোন উপলক্ষ তৈরি করে আবার যাব হুলহুলিয়া গ্রামে। আপনাদের নিশ্চয়ই আগ্রহ জন্মেছে এটি জানতে যে কি আছে সেই হুলহুলিয়া গ্রামে। হানিফউদ্দিন মিয়াই বা কে?
এখনও অনেকে জানেন না যে, বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার কে? এমনকি যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে তারাও জানে না যে কার হাত ধরে ৬৪ সালে আমরা কম্পিউটারের যুগে পা ফেলেছিলাম। মানুষটি যেমনি বিস্মৃত তেমনি ঘটনাটিও। অতি সম্প্রতি বিষয়টি আমাদের কোন কোন মিডিয়ার নজরে পড়েছে। সেটিও একটি সম্মাননা পাওয়ার পর। এই বিষয়টি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় এভাবে বলা হয়েছে। ‘দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হানিফউদ্দিন মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি। বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপো-২০১৫ শীর্ষক মেলার সমাপনী আয়োজনে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়। …সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অর্থমন্ত্রী (সাবেক) আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনেকটা পাদপ্রদীপের আলোয় না থাকা প্রয়াত এই প্রোগ্রামার এই ছোট আয়োজনের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। পত্রিকাটি আরও লিখেছিল- জানা গেছে, মূলত তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বারের প্রচেষ্টাতেই তাঁকে পুরস্কৃত করেছে আইসিটি বিভাগ ও বিসিএস। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী দেশের এই প্রথম প্রোগ্রামার সম্পর্কে কেন অজ্ঞাত ছিল দেশবাসী এমন প্রশ্নের উত্তরে মোস্তাফা জব্বার জানান, তিনি আসলে অনেকটা অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। তবে দেশের প্রতি তার টান ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটারটি আসে ১৯৬৪ সালে [তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে]। সেটি ছিল আইবিএম মেইন ফ্রেম ১৬২০ কম্পিউটার। বৃহদাকৃতির ওই কম্পিউটারটি স্থাপন করতে দুটি বড় রুম ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাউস আকারের সেই কম্পিউটারটিকে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে স্থাপন করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ডিজিটাল মেইনফ্রেম কম্পিউটার। এখানে বিশেষ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটার আইবিএম ১৬২০ তার হাত ধরেই বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে [টিএসসি সংলগ্ন] স্থাপিত হয়। পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এবং দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, প্রোগ্রাম উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং নানামুখী গবেষণা কাজে এটি ব্যবহার করেন। তবে ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটারটি কেন স্থাপিত হয়েছিল তা জানা প্রয়োজন। মোস্তাফা জব্বার জানান, পাকিস্তান সরকার তখন কম্পিউটারটি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপনের পরিকল্পনা করে। তবে হানিফউদ্দিন মিয়া ছাড়া অন্য কেউ এ কম্পিউটার তদারকি এবং পরিচালনার যোগ্য ছিলেন না। এ জন্য সরকার হানিফউদ্দিন মিয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার আহ্বান জানাল। তবে ওই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন হানিফউদ্দিন। ফলে কম্পিউটারটি ঢাকার আণবিক কমিশনে স্থাপনে অনেকটা বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।’
এখনকার সময়ে বিদেশ মানেই স্বর্গ। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য পাকিস্তানই ছিল স্বর্গ। কিন্তু হানিফউদ্দিন সেই স্বর্গের হাতছানি প্রত্যাখ্যান করেন। এদেশে কজন এমন মানুষ ছিল বা এখনও আছে? ২০১৬ সালের শেষ প্রান্তে তার জন্মস্থান নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব স্থাপনের কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে। ১৯ সালে আমরা সেই হাবটি দেখেছি। আমাদের সভাটি বস্তুত সেই হাবের পাশের প্রাঙ্গণেই আয়োজিত হয়েছিল। গ্রামটি এখন শতভাগ শিক্ষিত মানুষের গ্রাম। আরও একটি সুখবর হচ্ছে তার সঙ্গে কাজ করেছিলেন এমন আরও একজনের সন্ধান আমরা পেয়েছি যার নাম মুহম্মদ মুসা। আমি ভাগ্যবান যে এই মানুষটিকেও আমরা বেসিস সফটএক্সপোতে সম্মানিত করতে পেরেছি। তার কন্যাদের হাতে আমি দিতে পেরেছি সম্মাননা। সুযোগ পেলে মুসা মিয়ার জন্যও একটি স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে চাই। সমকাল হানিফউদ্দিন মিয়ার শিক্ষা ও পেশা নিয়ে আরও লিখেছে ‘কম্পিউটারের সঙ্গে সখ্যতা হলো কীভাবে হানিফউদ্দিন মিয়ার এটি জানতে হলে ফিরে যেতে হবে তার তারুণ্যে। বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের এই কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নবেম্বর নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
স্কুলশিক্ষক পিতা রজব আলী তালুকদারের দুই পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে। ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি এ্যান্ড অটোমেশন, চেকোশ্লোাভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে এ্যানালগ কম্পিউটার টেকনিক এবং ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে সিস্টেম এ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, এ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে এমআইটি [যুক্তরাষ্ট্র] কম্পিউটার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে আইবিএম রিসার্চ সেন্টার লন্ডন থেকে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে ট্রেনিং করেন। তারপর তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় প্রোগ্রামার এ্যানালিস্ট হিসেবে এ্যানালাইসিস, ডিজাইন, সফটওয়্যার ইম্পিøমেন্টেশন অব কম্পিউটার এ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯৫৭ সালে বিয়ে করেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফরিদা বেগম ও এক পুত্র এবং দুই কন্যাসন্তানের জনক দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মো. হানিফউদ্দিন উদ্দিন মিয়া। পুত্র শরীফ হাসান সুজা দীর্ঘ ২৩ বছর সিমেন্স বাংলাদেশে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অন্যদিকে তার মেয়ে ডোরা শিরিন পেশায় একজন ডাক্তার। আর অপর মেয়ে নিতা শাহীন গৃহিণী। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের এই কৃতী সন্তান বাংলাদেশ এ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস ডিভিশনের ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় কম্পিউটার সায়েন্স ও নিউমেরাল ম্যাথেমেটিকস থাকা সত্বেও শিল্প-সাহিত্যসহ আরও নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার ছিল অপরিসীম আগ্রহ। তিনি বাংলা ও ইংরেজী ছাড়াও উর্দু, আরবি, হিন্দী, জার্মান ও রাশিয়ান ভাষা জানতেন। ২০০৭ সালের ১১ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণিতশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশ গণিত সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মোহাম্মদ হানিফউদ্দিন মিয়ার নাম গভীরভাবে সম্পৃক্ত।’
বস্তুত হানিফউদ্দিন মিয়ার জীবনীটা এত কম কথায় প্রকাশ করা কঠিন। তবে এটি আমার একটি কষ্টের বিষয় যে এই মানুষটি জাতীয়ভাবে মোটেই পরিচিত নন। এমনকি লাখ লাখ কম্পিউটার শিক্ষার্থী বা কোটি কোটি ব্যবহারকারী হানিফউদ্দিন মিয়াকে চেনেন না। আমরা এমন মানুষকে যদি জাতীয়ভাবে সম্মানিত করতে না পারেন তবে সেটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। আমরা মনে করি এই মানুষটি আমাদের প্রথম স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে লাল-সবুজের এই দেশটিই বিশ্বের সেরা। পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অসাধারণ অবদান রেখে মোঃ হানিফউদ্দিন আমাদের সকলের প্রাত স্মরণীয় মানুষে পরিণত হয়েছেন। তিনি যে আমাদের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম যোগ্য ব্যক্তি সেটি সম্ভবত কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার হবে না।
ডাক অধিদফতর বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার মো হানিফউদ্দিন মিয়া এর স্মরণে দশ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করেন।
হানিফউদ্দন মিয়াকে নিয়ে আমার নিজের খুব ছোট স্মৃতিচারণ রয়েছে। ৯৭ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম আমাকে কম্পিউটার বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করার অনুমতি প্রদান করে। বাংলাদেশে কম্পিউটার নিয়ে এর আগে আর কোন অনুষ্ঠান হয়নি। তবে আমি এর আগেও এমন একটি অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করে আসছিলাম। কিন্তু ৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকার আমাকে পছন্দ না করায় এবং ৯৬ পরবর্তী সরকারের সহানুভূতি পাওয়ায় বিটিভির একজন প্রখ্যাত প্রযোজককে আমার এই অনুষ্ঠানটি করতে দেয়া হয়। সেই প্রযোজক লুৎফর রহমান তালুকদার এখন আর বিটিভিতে নেই। তবে তার সহকারী বরকত বহুদিন আমার কম্পিউটার অনুষ্ঠান করেছে। আমরা যে সাভার গিয়েছিলাম এবং আমার আরামবাগ অফিসে যে শূটিং করেছিলাম সেটি এখনও বরকত মনে করতে পারে। হানিফউদ্দিন মিয়ার কথাও বরকত ভোলেনি।
কম্পিউটার অনুষ্ঠানটি বরাবরই শিক্ষামূলক। তবে প্রথম কয়েকটি অনুষ্ঠান আমি একটু ভিন্ন মাত্রার করার কথা ভেবেছিলাম। সে জন্যই আমি ৬৪ সালে বাংলাদেশে আসা প্রথম কম্পিউটার নিয়ে আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠানটি সাজাই। তখনই জানা গেল কম্পিউটারটি সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনে আছে। আমরা সেখানে যাব ভাবলাম। লুৎফর ভাই বিটিভির আউটডোর ক্যামেরা ইউনিট বরাদ্দ নেন। আমি চাইলাম, সেই কম্পিউটার যিনি প্রথম ব্যবহার করেন তার একটি সাক্ষাতকার নেব। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির প্রথম সভাপতি এসএম কামালের কাছে খোজ পেলাম মোঃ হানিফউদ্দিন মিয়ার। পরে জানলাম বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির দ্বিতীয় সভাপতি সাজ্জাদ হোসেনের ভায়রা তিনি। সাজ্জাদ ভাই পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন এবং হানিফউদ্দিন সেই বিয়ের অনুঘটক ছিলেন।
সেই সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলাদেশের কম্পিউটারের ইতিহাসে এক বড় ধরনের মাইলফলক। কারণ হানিফউদ্দিন সেদিন বলেছিলেন এদেশে কম্পিউটার আসার কথা। আমি অবাক হয়েছিলাম এটি জেনে যে, তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের লাহোরে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা কম্পিউটারটি পাই। আমি স্মরণ করতে পারি, ভিডিও ক্যামেরায় সামনে সেটি তার প্রথম কথা বলা। অনেকটাই লাজুক টাইপের এই মানুষটির ব্যবহার এতটাই অমায়িক ছিল যে আমি অভিভূত হয়ে যাই।
এরপর বহুদিন তার খবর রাখি নাই। কামাল ভাই কম্পিউটার সমিতির আশপাশে থাকলেও সাজ্জাদ ভাই অনেকটা দূরে সরে যাওয়ায় আমি আর তার খবর নিতে পারিনি। আমি জানতাম, তিনি উত্তরায় থাকেন। আর কোন সংযোগ আমার ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি যে, কেমন করে এই সুবর্ণজয়ন্তীটি আমরা উদযাপন করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার যে আমি তখন কোন প্লাটফরম খুঁজে পাইনি সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি উদযাপন করার জন্য। পরমাণু শক্তি কমিশন সেটি উদযাপন করেনি।
২০১৫ সালের শুরুতে আমি সাভারের পিএটিসিতে সরকারী কর্মকর্তাদের একটি ব্যাচের ক্লাস নিতে গেলে সেখানে আমি হানিফউদ্দিনের কথা বলি। বস্তুত আমি ৯৭ সালের পর যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই হানিফউদ্দিন মিয়ার কথা বলেছি। ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসার পর এক তরুণ এসে জানাল তার বাড়ি হুলহুলিয়া গ্রামে, যে গ্রামে হানিফউদ্দিন জন্ম নিয়েছেন এবং যেখানে তার কবরও আছে। আমি তার কাছে হানিফউদ্দিনের বংশধরদের কারও ঠিকানা চাইলাম। তিনি তার ছেলে শরীফ হাসান সুজার ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা দিলেন। সেদিন মনে হলো হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম।
এমনিতেই ২০১৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি থাকাকালে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসার ৫০ বছর উদযাপনের জন্য চেষ্টা করি। তার আগে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির ২৫ বছর উদযাপনের জন্যও চেষ্টা করি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আমার সহায়ক হয়নি। তবে আমি হাল ছাড়িনি। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে আর কিছু না হোক দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষদের কাছে অন্তত হানিফউদ্দিন মিয়ার নামটা পৌঁছানো দরকার। এক কথায় যদি বলি তবে এর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সকলের দুয়ারে দুয়ারে আমি ঘুরেছি। আমি বেসিস-বিসিএস-পরমাণু শক্তি কমিশন, আইসিটি ডিভিশন সবাইকেই সুবর্ণজয়ন্তীর কথা বলেছি। জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্তও নেয়। কিন্তু কোনটাই কার্যকর হয়নি। একেবারে শেষ চেষ্টাটি কাজে লেগেছে। ২০১৫ সালে আইসিটি ডিভিশন ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি যখন বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোর আয়োজন করে তখন কোন এক কারণে আমি সেমিনার কমিটির চেয়ারম্যান হই। সেই সুবাদে এই ডিভিশনের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলকের সঙ্গে কথা হয়। পলককে হানিফউদ্দিনের কথা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এতে সম্মতি প্রদান করেন। এই ডিভিশনের কর্মকর্তারা আমার ঘাড়ে একটি বাড়তি দায়িত্ব দিলেন-তার পরিবারকে খুঁজে বের করার। আমি সেই কাজটিও করলাম। জানা গেল যে, তার স্ত্রী মারাত্মকভাবে অসুস্থ। সম্মাননা দেয়ার আগের রাতে আমি সেই মহিলার সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আসতে রাজি হননি। কিন্তু এক রকম জোর করেই আমি তাকে রাজি করালাম এবং সেদিন ১৭ জুন ২০১৫ সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে কেবল তিনি আসেননি তার তৃতীয় প্রজন্ম ছেলের ছেলে নাতি ইরফানকেও নিয়ে এলেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক ঘটনা। ইরফান সেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, আমি জানতামনা আমার দাদা এত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সত্যিকার অর্থে আমরাও জানতাম না তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন।
এবার ১ নবেম্বর প্রকাশিত হয়েছে হানিফউদ্দিন মিয়ার স্মারক ডাক টিকেট। এবারও ইরফান দাদার অনুষ্ঠানে এসেছিল। মায়ের অভিযোগ সারা দিনই গেম খেলে। তবে স্বীকার করলেন যে পরীক্ষায় ফলাফলে সেরা হয়ে থাকে। দাদার মতোই অঙ্কে অনেক ভাল। ইরফানের কাছে জানতে চাইছিলাম, বড় হয়ে কি হবে। ও লেভেলে পাঠরত ইরফান দাদার পথ ধরে হাঁটবে। সে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হতে চায়। এরই মাঝে সে প্রোগ্রামিং শিখেছে। আশা করি আমরা হানিফউদ্দিন মিয়ার উত্তরাধিকারী হিসেবে ইরফানকে পাব। অনেক শুভ কামনা ইরফানের জন্য।
ঢাকা, ১ নবেম্বর ২০১৯
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কী-বোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক mustafajabbar@gmail.com
সুত্র জনকণ্ঠ