মঙ্গলবার ● ১ অক্টোবর ২০১৯
প্রথম পাতা » আইসিটি জার্নাল » ‘খ্যাপে’ নয় ‘অ্যাপে’ চলুন
‘খ্যাপে’ নয় ‘অ্যাপে’ চলুন
২০১৫ সালের মাঝামাঝি রাইড শেয়ারিং সেবার সূচনা দেশের পরিবহন খাতে উল্লেখযোগ্য এক নতুন সংযোজন হিসেবে দারুণ সাড়া ফেলে। রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেবা যেমন বিপুল সংখ্যক নাগরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তেমনি সামাজিকভাবেও রাইড শেয়ারিং তুমুল আলোচনা ও কৌতূহলের জন্ম দেয়।
গণপরিবহন খাতে বিগত দশকগুলোর মধ্যে যে কয়টি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে রাইড শেয়ারিং অন্যতম। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ‘উবার’, দেশীয় উদ্যোগ ‘পাঠাও’, ‘পিকমি’ ও ‘সহজ’-এর মতো প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব পরিবহন খাতে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখায়। রাজ্যের ব্যস্ততায় ব্যাকুল নাগরিকদের যাতায়াতের সুবিধায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাইড শেয়ারিং সেবা। রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে দুয়ার খোলে পরিবহন খাতের এক আধুনিক পর্বের।
আলোচনা ও সমালোচনায় মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনামও হয় এই রাইড শেয়ারিং সেবা। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা এ সেবাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবুও সমালোচনার বোঝা সয়ে ও ভর্তুকি দিয়ে হলেও টিকে থাকার স্বপ্ন দেখে এই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। গতানুগতিক পরিবহন ব্যবস্থার ধ্যান-ধারণায় বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে রাইড শেয়ারিং। বিশেষত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট অ্যাপসের মাধ্যমে এই সেবায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের পরিবহন খাতে একেবারেই নতুন ধারণা। এতদিনের প্রথাগত পরিবহন সংকট থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই সেবা। রাইড শেয়ারিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে এই ব্যস্ত মহানগরের মানুষ।
এমন প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং সেবা খাতে শৃঙ্খলা আনয়নে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’ প্রণয়ন করেছে সরকার। ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে এই নীতিমালা অনুমোদন করে সরকার। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে সেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে সেটা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। জনস্বার্থে জারিকৃত এই নীতিমালা ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখ থেকে কার্যকর রয়েছে।
রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে প্রায় ৩ হাজার স্নাতক ডিগ্রিধারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও তরুণদের আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাইড শেয়ারিং সেবায় প্রায় এক লক্ষ ‘চালক’-এর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন ঘটবে। এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে অবদান রাখার পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতির এক বড় চ্যালেঞ্জ তীব্র আয়-বৈষম্য কমাতেও ভূমিকা রাখা সম্ভব। এছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করা, কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখার পথ তৈরি হয়েছে এই সেবার মধ্য দিয়ে। সর্বোপরি বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে ভূমিকা রাখছে রাইড শেয়ারিং সেবা।
কিন্তু দ্রুত মার্কেট শেয়ার দখলের জন্য অসুস্থ ‘প্রমোকোড’, ‘কোয়েস্ট বোনাস’ ও ‘চালকের কাজ থেকে প্রাপ্ত কমিশন’ মওকুফের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব ও বৈদেশিক বিনিয়োগকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। কর্মবিমুখ মোটরযান চালক যখন কর্মসংস্থানের একটি নির্ভরযোগ্য প্লাটফর্ম পেল ঠিক তখনই ‘অ্যাপভিত্তিক’ সেবা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘খ্যাপে’ রাইড শেয়ারিংকে উদ্বুদ্ধ করার পথ বেছে নিচ্ছে তারা। শুরুতে নিয়ম মেনে ‘অ্যাপস’-এর মাধ্যমে পরিচালিত হলেও এখন একশ্রেণির অসাধু চালকের বেশি আয়ের আশায় এই ব্যবস্থাটি প্রায় ভেঙে পড়েছে। ‘অ্যাপ’ রেখে এখন তারা ‘খ্যাপে’ ঝুঁকছে।
কিন্তু এভাবে চুক্তিতে গন্তব্যে যাত্রী পৌঁছে দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়তে থাকায় নানারকম ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে নানা রকম হয়রানি ও নিরাপত্তার ঝুঁকি। কোনো নির্জন স্থানে নিয়ে চালক যেমন যাত্রীর ক্ষতি করতে পারে, তেমনি চালকও যাত্রীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ অ্যাপ ছাড়া যাত্রী তোলায় কে উঠছে সেই তথ্য থাকছে না কোথাও। ভাড়াও গুনতে হচ্ছে বেশি। তার ওপর এভাবে চুক্তিতে গেলে যাত্রীর পছন্দের গন্তব্যে পৌঁছাতেও আপত্তি করার সুযোগ থাকে চালকদের।
গত ২৫ আগস্ট দিবাগত রাতে মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। মিলন নামে এক বাইকারকে খুন করে তার মোটরসাইকেলটি ছিনিয়ে নিয়ে গেছে একজন দুর্বৃত্ত। পুলিশ বলছে, খুনি যাত্রীবেশে মিলনের বাইকে চড়েছিল। কিন্তু তারা এখনো খুনিকে শনাক্ত করতে পারেনি। যদি অ্যাপের মাধ্যমে ভাড়ায় ওই যাত্রীকে নেওয়া হতো, তাহলে তার নাম-পরিচয়সহ প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া সহজ হতো। কিন্তু চুক্তিতে তাকে তোলায় কোনো তথ্যই নেই কারও কাছে। ফলে নানা রকম হয়রানির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে দেশের রাইড শেয়ারিং সেবা আসলে কোন পথে যাচ্ছে?
সম্ভাবনাময় এই সেবা খাতকে টিকিয়ে রাখতে যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অফলাইনে রাইড শেয়ারিং বন্ধের জন্য সকল অংশীজনের সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ মহানগরের সড়কগুলো থেকে অনাকাক্সিক্ষত সেবা বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারে। রাইড শেয়ারিং সেবার অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। চালকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে ‘ই-প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট’ গড়ে তোলা যেতে পারে। রাইড শেয়ারিং সেবার বিকাশকালীন পর্যায়ে এখন ‘কর-ভ্যাট অব্যাহতি’ দিলে এ খাতের উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখবে। রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য একটি ‘স্বতন্ত্র ভাড়া নির্ধারণী নীতি’ প্রণয়ন করা গেলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা অসুস্থতায় রূপ নেবে না। একই সঙ্গে অসুস্থ ‘প্রমোকোড’, ‘কোয়েস্ট বোনাস’ ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে নতুবা ঊষালগ্নেই এই সেবা খাতের অকালমৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
লেখক : হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট,
পিকমি লিমিটেড
সূত্র দেশরুপান্তর