সোমবার ● ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » আইসিটি জার্নাল » বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা এখন পাঁচ লাখ
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা এখন পাঁচ লাখ
তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ববাজারে আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন অতি পরিচিত নাম। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট ২০১৯’-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বর্তমানে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার (৮০০ কোটি টাকা) আয় করছে। আউটসোর্সিংয়ের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা এখন পাঁচ লাখ। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দিকনির্দেশনায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল অগ্রযাত্রার একটি বড় প্রমাণ জাতিসংঘের এ তথ্য। সরকারের অনুকূল নীতির কারণেই বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক পেশাজীবী নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন।
বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা: আঙ্কটাডের রিপোর্ট বলছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে মাত্র ১০ হাজার ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন। ২০১৩ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা এখন পাঁচ লাখ। ২০১১ সালে ডিজিটাল আউটসোর্সিং থেকে যেখানে বাংলাদেশের আয় ছিল ১ কোটি ডলারের নিচে, সেখানে এখন এ আয় দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ডলারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কম খরচ, কাজের গুণগত মান ও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকির বিবেচনায় এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ উন্নত বিশ্বের বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকেই ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ে দক্ষ পেশাজীবী তৈরির জন্য একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতে থাকে। যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা নিজেরাও অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এভাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ফ্রিল্যান্সারদের দেশে উন্নীত হয়েছে।
বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় পরিসংখ্যানদাতা প্রতিষ্ঠান জার্মানিভিত্তিক স্ট্যাটিসটার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের বাজারের আকার কমতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে যেখানে বিশ্ববাজারে আকার ছিল ১০৪ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এসে বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে ৮৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ বিশ্নেষণ করে বলা হয়, ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাজারের আকার ৮০ থেকে ৮৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে থাকতে পারে। প্রতিবেদনে বাজারের আকার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, বিশ্ববাজারে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এ কারণে আগের চেয়ে কমমূল্যে কাজ করাতে পারছে কোম্পানিগুলো। ফলে ফ্রিল্যান্সার ও কাজের সংখ্যা বাড়লেও আর্থিক লেনদেনে বাজারের আকার কমেছে।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এজিলইঞ্জিনের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের বাজারের সবচেয়ে বেশি দখল রয়েছে ভারতের। আর প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি মূল্য পান ব্রাজিলের ফ্রিল্যান্সাররা।
ডিজিটাল আউটসোর্সিং যেভাবে: সাধারণত বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডাটাবেজ তৈরি, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, রিপোর্ট প্রসেসিংয়ের মতো কাজগুলো আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে করিয়ে থাকে। আগে বড় বড় কোম্পানি শুধু বিভিন্ন দেশের তৃতীয় আরেকটি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাত। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষে অনলাইন ব্যবস্থার অগ্রগতির কারণে এখন বড় বড় কোম্পানি অনলাইনেই তাদের কাজ দিচ্ছে। এ জন্য গড়ে উঠেছে একাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ খুঁজে নিচ্ছেন ফ্রিল্যান্সাররা। ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথাগত চাকরির চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করা যায়। নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম থেকে কাজ খুঁজে নিয়ে সুবিধাজনক সময়ে নিজের বাসায় বসেও করা যায়।
সম্ভাবনা ও সংকট: বাংলাদেশের সফল ফ্রিল্যান্সারদের একজন তাহমিনা বেগম ইমা। তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের লার্নিং-আর্নিং প্রকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের জন্য প্রশিক্ষণ নেন। এরপর নিজের উদ্যোগে আরও কিছু কাজ শেখেন। এখন তিনি বেশ স্বচ্ছন্দে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে কাজ পাচ্ছেন।
ইমা জানান, বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা আগের চেয়ে নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন এবং কাজও বেশি পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কিছু পরামর্শও দেন।
তার প্রথম পরামর্শ, এখন পর্যন্ত অনেক ফ্রিল্যান্সারই কোন প্ল্যাটফর্ম বা মার্কেট প্লেস থেকে কাজ পাওয়া সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হবে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না। এ ব্যাপারে বাড়তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই ক্রেতা কী চাচ্ছেন, তা ফ্রিল্যান্সাররা বুঝতে পারেন না। এ জন্য বন্ধু কিংবা অন্য কারও সহায়তা নিতে হয়। ফ্রিল্যান্সারদের ইংরেজির দুর্বলতা কাটানোর ব্যবস্থা নেওয়াটাও জরুরি।
তার মতে, দীর্ঘদিন ধরে আরেকটি বড় সমস্যা ‘পেমেন্ট’ এবং এটি এখনই দূর করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ সম্পর্কে তিনি জানান, বিশ্ববাজারের বেশিরভাগ ক্রেতা শুরুতেই জানতে চান পেপাল অ্যাকাউন্ট আছে কি না। সমস্যা হচ্ছে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ঠিকানায় পেপাল অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না। ফলে কাজের মূল্য পাওয়ার জন্য অনেককেই তৃতীয় আরেকজনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হয়। এটা অস্বস্তিকর এবং ঝুঁকিপূর্ণও। এ জন্য বাংলাদেশ থেকে পেপাল অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ তার। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ফেসবুকে অনেক চটকদার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, ‘এক সপ্তাহে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ঘরে বসে লক্ষ টাকা আয়’। এগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রতারণার ফাঁদ। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘ প্রচেষ্টায় একজন ফ্রিল্যান্সারকে তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ববাজারের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়।