রবিবার ● ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
প্রথম পাতা » ডিজিটাল বাংলা » দেশে ৪ ধরনের নতুন সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে
দেশে ৪ ধরনের নতুন সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে
বর্তমানে ভার্চুয়াল জগতে বাংলাদেশের প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১১ ধাপে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর মধ্যে চারটিই নতুন। এগুলো হলো- ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি, কপিরাইট আইন লঙ্ঘন, পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার এবং অনলাইনে কাজ করিয়ে নেয়ার কথা বলে প্রতারণা। আক্রান্তদের মধ্যে নারী ভুক্তভোগীদের সংখ্যা বেড়েছে ১৬.৭৭ শতাংশ। তবে ভুক্তভোগীদের ৮০.৬ শতাংশই আইনের আশ্রয় নেন না।
আজ রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসব তথ্য জানিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন)। সাইবার সচেতনতা মাস (ক্যাম) অক্টোবর-২০১৯-এর আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সহ-আয়োজক ছিল নবগঠিত ‘থিংক-ট্যাংক ফর সিকিউর ডিজিটাল বাংলাদেশ’। এতে সভাপতিত্ব করেন সিসিএ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ। গবেষণা প্রতিবেদনে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তায় অংশীজনদের প্রতি ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
আলোচনায় অংশ নেন দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, নবগঠিত থিংক ট্যাংক ফর সিকিউর ডিজিটাল বাংলাদেশের আহ্বায়ক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী সৈয়দ জাহিদ হোসেন, প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টারের ডিরেক্টর (মার্কেটিং) মাহবুব উল আলম, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী ও সাহিত্য সাংবাদিক শাহরোজা নাহরিন। সঞ্চালক ছিলেন সিসিএ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুন আশরাফী।
গবেষণায় যেসব তথ্য উঠে এসেছে
অপরাধের ধরন: ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে জেঁকে বসেছে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেয়ার ঘটনা। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের পরও এই মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছেন অপরাধীরা। একইসঙ্গে নতুন এই সারিতে যুক্ত হয়েছে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন, অনলাইনে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার এবং অনলাইনে কাজ করিয়ে নেয়ার কথা বলে প্রতারণা।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার অপরাধে আক্রান্তদের মধ্যে ফোনে বার্তার মাধ্যমে হুমকির শিকার হচ্ছেন ৬.৫১ শতাংশ। কপিরাইট লঙ্ঘনের মাত্রা ৫.৫৮ শতাংশ দখল করেছে। অনলাইনে কাজ করিয়ে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ১.৪০ শতাংশ। জরিপের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এগুলো দেশে নতুন ধরনের অপরাধ। আর এতোদিন পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটলেও এবার সামনে এসেছে এর ব্যাতিক্রমী ঘটনা। অনলাইনে বিক্রিত পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ০.৪৭ শতাংশ।
সিসিএ ফাউন্ডেশনের ২০১৮ সালের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংঘটিত অপরাধের চেয়ে এবারের জরিপে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে পর্ণোগ্রাফি। এই অপরাধ ২.২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে। একইভাবে থেমে নেই অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির ঘটনা। এই অপরাধটি ১৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭.৬৭ শতাংশ।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা কিছুটা কমলেও এখনো তা আশঙ্কাজনক। ভুক্তভোগীদের ২২.৩৩ শতাংশই এই ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন। আগের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৭.০৭ শতাংশ। ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের ঘটনা রয়েছে আগের মতোই। এবার এই হার ১৫.৩৫ শতাংশ।
দেশে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণাও। ভুক্তভোগীদের ৭.৪৪ শতাংশ এই অপরাধের শিকার, যা আগের প্রতিবেদনে ছিল ৮.২৭ শতাংশ।
অবশ্য আশার কথা সময়ের সঙ্গে কমেছে অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা। এবারের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এই অপরাধে ভুক্তভোগীদের হার ০.৪৭ শতাংশ। গত প্রতিবেদনে এই হার ছিল ৩.০১ শতাংশ।
ভুক্তভোগীদের বয়স: জরিপে বয়সভিত্তিক সাইবার অপরাধে আক্রান্তের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে এদের মধ্যে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮-৩০ বছরের কম। পরিসংখ্যানে ভুক্তভোগীদের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিশু। ১৮ বছরের কম বয়সী এই ভুক্তভোগীদের হার ১১.১৬ শতাংশ। অন্যদিকে ৩০-৪৫ বছর বয়সী প্রযুক্তি ব্যবহারকারী ভুক্তভোগী ৩.৭২ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের বেশি ভুক্তভোগীদের হার ০.৪৭ শতাংশ।
জেন্ডারভিত্তিক অপরাধ : গতবারের চেয়ে এবার সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী নারীদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এবার এই হার ৬৭.৯ শতাংশ। গতবার ছিল ৫১.১৩ শতাংশ। অপরাধের জেন্ডারভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ অপরাধে ভুক্তভোগী নারীর সংখ্যাই বেশি। এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছেন তারা। এতে নারীর হার ১৬.৩ শতাংশ এবং পুরুষ ৬.০৫ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। এখানে ৩.৭২ শতাংশ পুরুষ ভুক্তভোগী হলেও নারীর হার ১৪ শতাংশ। অপরাধের ধরনে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ছবি বিকৃতি করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১.২ শতাংশ; পুরুষ ৪.১৯।
আইনের আশ্রয়: দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ণ হলেও এই আইনে আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা আশানুরূপ নয়। হয়রানির শিকার হয়েও আক্রান্তদের ৮০.৬ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেন না। আর যারা নেন তাদের মধ্যে মাত্র ১৯.২ শতাংশ আইনি সহায়তা চেয়ে ‘আশানুরূপ ফল’ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। আশার কথা হলো এবার এই হার বেড়েছে। গতবারের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ৭ শতাংশ।
অভিযোগ কেন করেন না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগীদের ২৩ শতাংশই বিষয়টি ‘গোপন রাখতে’ চেপে যান বলে জানান। ২২.৭ শতাংশই জানেন না কিভাবে আইনি সহায়তা নেয়া যায়। আর ১৯.৩ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির আশঙ্কায় ভোগেন। এছাড়াও অভিযোগ করেও লাভ হবে না বলে মনে করেন ১৬ শতাংশ। জরিপে দেখা গেছে, ১৩.৩ শতাংশ সামাজিক ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্নের ভয়ে এবং ৩.৯ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায়, ভয়ে আইনের আশ্রয় নেন না। অন্যদিকে সাইবার অপরাধের প্রতিকার বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন না ৬৩ শতাংশ ভুক্তভোগী।
ভুক্তভোগীদের পরামর্শ: গতবারের চেয়ে এবারের জরিপে ৫ শতাংশ বেশি ভুক্তভোগী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এবার ৩৪ শতাংশই বলেছেন সচেতনতা না বাড়ালে এই অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটবে। এদের বাইরে ২০.১ শতাংশ আইনের প্রয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। আর অপরাধীদের তাৎক্ষণিক শাস্তি দেয়া গেলে এই নিরব ঘাতকের হাত থেকে পরিত্রাণ মিলবে বলে মত দিয়েছেন জরিপে অংশ নেয়া ৪৫.৯ শতাংশ ভুক্তভোগী।
অনুষ্ঠানের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তায় ১০ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইবার পাঠ অন্তর্ভুক্তকরণ, অফিস-আদালতে দায়িত্বশীল পদে সৎ ও নৈতিক জনবল নিয়োগ নিশ্চিতকরণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে প্রশিক্ষিত জনবল বাড়ানো, সাইবার নিরাপত্তার কাজে দেশি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দেয়া, সাইবার নিরাপত্তা কাজে অংশীজনদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব সেবায় দেশীয় প্রযুক্তিকে জনপ্রিয়করণ, প্রবাসী জনশক্তিকে কাজে লাগানো ও বেসরকারি উদ্যোগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
গবেষণা প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে ccabd.org ওয়েবসাইটে।